দখল আর দূষণে কর্ণফুলীর একাধিক খাল অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে। খাল ভরাট করে কোথাও বাড়িঘর, কোথাও টয়লেট অথবা কোথাও মার্কেট এবং নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে দেখা গেছে। উপজেলায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে কোথাও শতাধিক গরুর খামারের বর্জ্যে খাল ভরাট হয়ে ডোবাতে পরিণত হতে। অন্তত এক দেড় দশক আগেও কর্ণফুলীর উপজেলার সবগুলো খাল দিয়ে নৌ চলাচল করতো।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দোকানের পণ্য খাতুনগঞ্জ পাইকারি মোকাম থেকে চাক্তাই খাল হয়ে সরাসরি কর্ণফুলী নদীর উপর দিয়ে উপজেলার শাখা খালে প্রবেশ করত। তবে এখন দেড় দশকের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে আগের সেই চিত্র। এখন পণ্য পরিবহনের যাত্রা স্থলপথের বিকল্প ভাবতে পারছে না স্থানীয়রা। খালের উপরে সাম্পান ছুটে চলার বিষয় এখন রূপকথায় পরিণত হয়েছে শিশু-কিশোরদের কাছে। এখানকার অধিকাংশ খালে প্রবেশ করে না জোয়ারের পানিও। অথচ খালের হাত দূরত্বেই কর্ণফুলী নদীর অবস্থান। সীমাহীন দখল, বেপরোয়া দূষণ ও প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকার কারণে এসব খালের এমন পরিণতি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
বাদামতল খাল আবর্জনার ভাগাড়ে : মাত্র এক দশকের ব্যবধানে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের বাদামতল খালটি আবজর্নার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বাদামতল মোড় থেকে সৈন্যারটেক পর্যন্ত এই খালের প্রতি বাঁকেবাঁকে দখলের চিত্র দেখা গেছে। খালের উপর ভবন উঠানোর চিত্র দেখা গেছে সরিজমিনে। কেউ ঘর, কেউ টয়লেট অথবা কেউ রান্নাঘর ; বাড়ির সামনে থাকা খাল পাড় ও খাল দখল করেছে অন্তত শতাধিক পরিবার। এর বাইরেও চরপাথরঘাটা গ্রামের শতাধিক পরিবার, ভাড়াঘর ও দোকানপাটের যাবতীয় ময়লা আবর্জনা খালের উপরে ফেলে পুরো খাল ভরাট করে ফেলা হয়েছে। বাদামতল, মোহসেন আলী পাড়া ঘুরে দেখা গেছে এসব পাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাদামতল খাল ভরাট হয়ে ময়লার ভাগাড় ও ডোবাতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় অবৈধ দখলে খালটি ছোট হয়ে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়ে।
চরপাথরঘাটা গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ সালাউদ্দীন বলেন, এই খালটি দখল ও দূষণের কারনে পানি চলাচল করে না। কার্যকর নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর চরপাথরঘাটা হাজারো পরিবার জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে দুর্ভোগ পোহান।
ডেইরি ফার্মের বর্জ্যে শিকলবাহার খাল : কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা খালের দুই পাশে রয়েছে অন্তত ছয় শতাধিক ডেইরি ফার্ম। এসব ফার্মে প্রায় ২৫ হাজার গরু লালন-পালন করা হয়। প্রাণিসম্পদ দপ্তরের এক হিসেবে দেখা গেছে ছয় শতাধিক ফার্মে প্রতিদিন তিন হাজার মেট্রিক টন গোবর ও দুই লাখ লিটার মূত্র উৎপন্ন হয়। ছয়শতাধিক ফামের্র মাত্র ৫০টি ফার্মে গোবর প্রক্রিয়াজাতকরণ ও অপসারণের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি ৫৫০টি ফার্মের বর্জ্য সরাসরি যায় শিকলবাহা খালে। সাড়ে পাঁচশ ডেইরি ফার্মের বর্জ্যে শিকলবাহা খালটি এখন নোংরা ডোবা ও গোবরের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। খালে ফেলা বর্জ্য থেকে আসা তীব্র দুর্গন্ধে সড়কে হাটা দায় হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা বলছেন এই খালে এখন মাছ নেই। খালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় গন্ধে গা গুলিয়ে যায় পথচারীর।
কৃষকরা জানান, একসময় শিকলবাহা খালের পানি দিয়ে স্থানীয়রা জমি চাষ করতেন। এখন দূষণের কারণে কৃষিতে এই পানি ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
নিয়ম-নীতির লঙ্ঘন করে দিনের পর দিন প্রকাশ্যে ডেইরি ফার্ম কীভাবে শিকলবাহা খালে বর্জ্য ফেলছেন? এই প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানালেন, উপজেলা পর্যায়ে জনবল না থাকায় কারণে কিছু বিষয় তাদের এড়িয়ে যায়। তবে ইতিপূর্বে খাল দূষণের পেছনে জড়িত কিছু ফার্ম মালিককে পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করেছিল বলে তিনি জানান।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট ছাড়া কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ নেই বলে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা নিয়মনীতি অমান্য করছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চরলক্ষ্যা এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় শতাধিক ডেইরি ফার্মের গোবর ও মূত্রে শিকলবাহা খাল বিপর্যস্ত। শত শত ডেইরি ফার্মের বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলার কারণে দূষণ এখন ভয়াবহ। দেড় দশক আগে শুরু হওয়া এই দূষণ ইতিমধ্যে খালের পানির মান সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিয়েছে। অধিকাংশ ডেইরি ফার্মের গোবর ও মূত্র মিশ্রিত দূষিত পানি পাইপ ও ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি খালে ফেলতে দেখা গেছে যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয়।
বৃদ্ধ আবেদ আলীর বাড়ি চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডে। তিনি ডেইরি ফার্ম মালিকদের অব্যবস্থাপনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘জন্মের পর থেকে এই খাল আমাদের জীবনের অংশ ছিল। বছরের পর বছর এই খালে আমরা গোসল করেছি। খালে কাপড়চোপড় ধোয়াসহ দৈনন্দিন নানা কাজে খালের পানি ব্যবহার করতাম। পুকুরের পানির মতো পরিষ্কার ছিল। কিন্তু গত ১০/১৫ বছর ধরে ডেইরি ফার্মের বর্জ্য ফেলায় খালটি ধ্বংস হয়ে গেছে। ফার্মের মালিকরা গরু ও দুধ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আয় করেন। কিন্ত তারা ফার্মের ময়লা-আবর্জনা খালে ফেলবেন কেন?
উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের দাবি ডেইরি ফার্মের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আগেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একটা সময় ফার্ম মালিকরা তাদের বর্জ্যগুলো খালে ফেললেও এখন তা কমে এসেছে। পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের সচেতন করা হয়েছে। এছাড়া, আমরা ফার্ম মালিকরে বর্জ্য পরিশোধনের জন্য বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
এসব খালের বাইরেও উপজেলার অন্যান্য খালও প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত চরলক্ষ্যা-শিকলবাহা খাল, চরলক্ষ্যা-চরফরিদ খাল, লেইঙ্গা খাল, মামা ভাগিনার খাল, চরলক্ষ্যা-খোয়াজনগর খাল এবং চরলক্ষ্যা-বালুরচর খাল।
পূর্বকোণ/ইব