চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫

সর্বশেষ:

চট্টগ্রাম নগরীর ২০০ পাহাড়ের ১২০টি বিলুপ্ত

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১২:০২ অপরাহ্ণ

একসময়ে টাইগারপাস পাহাড়ে বাঘ দেখা যেত। এখনও বাঘ দেখা যায়। তবে বনের বাঘ নয়, পাথরের বানানো প্রতিকৃতি। ইংরেজ সিভিলিয়ান এ এল ক্লে ১৮৯৬ সালে তাঁর প্রকাশিত লিডস ফ্রম এ ডায়েরি ইন লোয়ার বেঙ্গল নামক স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘চাটগাঁ ছিল তখন জঙ্গলাকীর্ণ। দিনে-দুপুরেও বাঘের গর্জন শোনা যেত। চাটগাঁর সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা ছিল টাইগার পাস। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সমুদ্র বরাবর।’

 

টাইগারপাস পাহাড়ের সঙ্গে প্রেমিক যুগলের মতো জড়িয়ে আছে বাটালি পাহাড়। এই পাহাড় চূড়া থেকে স্পষ্টভাবে বঙ্গোপসাগর দেখা যেত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ পাহাড়ের শীর্ষে বিমান বিধ্বংসী কামান বসানো হয়েছিল। চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ‘পাহাড়ের’ নৈসর্গিক নাম জড়িয়ে রয়েছে। কালের পরিক্রমায় পাহাড় কেটে ন্যাড়া-সাবাড় করা হয়েছে। অপরূপ সৌন্দর্যের রাণী চট্টগ্রামের রূপ-লাবণ্য ও সৌন্দর্য অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে। ধ্বংসের পথে প্রাণ-প্রকৃতি।

 

পাহাড় কাটা শুরু : বিভিন্ন গবেষণা সূত্র বলছে, ১৭৬০ সালে ব্রিটিশ আমলে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ চট্টগ্রামে প্রথম পাহাড় কাটা শুরু হয়। পাহাড় কেটে বানানো হয় আবাসিক, বাংলো, অফিস-আদালত। ১৯৫০ সালে নগরের ষোলশহর, নাসিরাবাদ, পাহাড়তলী ও ফৌজদারহাট এলাকায় শিল্প এলাকা স্থাপনের জন্য কিছু পাহাড় কাটা হয়। দেশ স্বাধীনের পরও ব্যাপকভাবে পাহাড় কাটা হয়। ৯০ দশকের পর থেকে পাহাড় কাটা রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত হয়। এতে পাহাড়ধস ও প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে।

 

জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারি পাহাড় অবৈধভাবে দখল ও নির্বিচারে কেটে বস্তিঘর তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়। রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী ব্যক্তি, আবাসন ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশের গুটিকয়েক সদস্যও পাহাড় দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন।

 

পাহাড় কাটা থেমে নেই : পাহাড় কাটা নিয়ে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন। তাঁর গবেষণায় বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরে এক সময় ছোট-বড় ২০০টি পাহাড় ছিল। ইতিমধ্যে ১২০টি পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচটি থানা (বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালী ও পাহাড়তলী) এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে এসে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটারে। গত ৩২ বছরে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। যা মোট পাহাড়ের ৫৭ শতাংশ।

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হক পাহাড় কাটা নিয়ে গবেষণা করেছেন। ‘হিল কাটিং ইন এন্ড এরাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক গবেষণাটি ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়। এ গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৩২ বছরে নগর ও আশপাশে ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ ও ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয়েছে। চট্টগ্রামের ৮৮টি পাহাড় পুরোটাই বিলুপ্ত হয়েছে। আংশিক কাটা হয়েছে ৯৫টি। চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের এলাকার ৫৭ শতাংশ পাহাড় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে।

 

পাহাড় কমে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক জি এন তানজিনা হাসনাত ও একই বিভাগের মোহাম্মদ আলী বাবু ‘আরবান ল্যান্ডস্কেপ চেঞ্জ ডিটেকশন ইউজিং জিআইএস অ্যান্ড আর এস’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে। ২০২২ সালে প্রকাশিত সেই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড়-জঙ্গলের সবুজ কমেছে ২১ দশমিক ৮২ শতাংশ আর পুকুর-জলাশয় কমেছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ১৯৯০ সালে নগরের মাত্র ১৯ শতাংশ এলাকায় বসতি থাকলেও এখন ৪৫ শতাংশ এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে।

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক খালেদ মিসবাহ উজ্জামান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার এক সেমিনারে ‘হিল কাটিং ইন চিটাগাং সিটি’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত ৪০ বছরে হারিয়ে গেছে ১২০টি পাহাড়। এসব গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পাহাড় হারানোর জন্য মূলত মানুষই দায়ী। এরফলে বনজসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। এতে ভূমি ক্ষয় ও পাহাড়ধসে পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল হুমকির মুখে পড়েছে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নাফিস আহমদ প্রথম চট্টগ্রাম শহরের ‘পাহাড় কাটা’ নিয়ে গবেষণা করেন। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, পাহাড় কাটা একটি পরিবেশগত সমস্যা। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের চাপে চট্টগ্রাম নগরের পাহাড় ক্ষয়িঞ্চু। পাহাড় কাটাকেই পাহাড়ধসের মূল কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়। এরফলে পলি জমে নালা-নর্দমা ভরাট ও নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতার।

 

স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধস : ২০০৭ সালে ১১ জুন মতিঝর্ণা এলাকায় ভয়াবহ পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। পাহাড় ধসের ২৮ কারণ চিহ্নিত করে ধস রোধে ৩৬ সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। সুপারিশের মধ্যে ছিল-পাহাড়ে জরুরিভাবে বনায়ন, গাইড ওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন-মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা। পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারণের ব্যবস্থা করা। যত্রতত্র পাহাড়ি বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করা, ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না দেয়া, মতিঝর্না ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনা নিষিদ্ধ করা। দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৮ বছরেও এসব সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করা হয়নি। উল্টো নির্বিচারে-নির্বিঘ্নে পাহাড় কাটা চলে আসছে।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট