চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫

সর্বশেষ:

চট্টগ্রামে নগরায়ণের কোপ শতাধিক পাহাড়ে

মিজানুর রহমান

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ‘পাহাড়ের’ নৈসর্গিক নাম। তবে কালের পরিক্রমায় নগরায়ণ ও শিল্পায়নের চাপে অনেক পাহাড় কেটে ন্যাড়া-সাবাড় করা হয়েছে। ফলে অপরূপ সৌন্দর্যের রাণী চট্টগ্রামের রূপ-লাবণ্য ও সৌন্দর্য অনেকটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতি।

 

৪০ বছরে ১২০ পাহাড় বিলুপ্ত :

চট্টগ্রামে প্রথম পাহাড় কাটা শুরু হয় ১৭৬০ সালে ব্রিটিশ আমলে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির’ হাত ধরে। পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালেও কিছু পাহাড় কাটা হয়। তবে ৯০ দশকের পর থেকে পাহাড় কাটা রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত হয়। ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত ৪০ বছরে হারিয়ে গেছে ১২০টি পাহাড়। নগরায়ন ও শিল্পায়নের চাপে ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে চট্টগ্রামের পাহাড়।

 

গবেষণায় দেখা গেছে, নগরীতে এক সময় ছোট-বড় ২০০টি পাহাড় ছিল। ইতিমধ্যে ১২০টি পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গত ৩২ বছরে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। যা মোট পাহাড়ের ৫৭ শতাংশ। গত ৩০ বছরে পাহাড়-জঙ্গলের সবুজ কমেছে ২১ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর পুকুর-জলাশয় কমেছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

 

দ্রুত কমছে ফসলি জমি :

সীতাকুণ্ডে শিল্পের দ্রুত বিকাশে কমছে ফসলি জমি। সলিমপুর থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত ১০টি ইউনিয়নেই পাল্লা দিয়ে ফসলি জমি কমায় খাদ্য ও শস্যভাণ্ডার খ্যাত এ উপজেলা কৃষিতে তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী এক দশকেই সবজি ও খাদ্যের জন্য সীতাকুণ্ডের মানুষকে দেশের অন্য অঞ্চলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।

 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সীতাকুণ্ড উপজেলার সর্ব দক্ষিণের তিন ইউনিয়ন হচ্ছে- কুমিরা, ভাটিয়ারি ও সলিমপুর। নগরীর খুব কাছে এসব ইউনিয়নের অবস্থান হওয়ায় সেখানে সবচেয়ে বেশি শিল্পায়ন হয়েছে। এই তিন ইউনিয়নের পূর্বে পাহাড় থেকে পশ্চিমে সাগর উপকূল পর্যন্ত সাবখানে কারখানা স্থাপনের প্রতিযোগিতায় কৃষিজমি এক-দশমাংশে নেমে এসেছে।

 

দখল দূষণে নদী-খাল :

পৌনে ৮০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ফটিকছড়িতে ছোট-বড় ২৩টি নদী-খাল রয়েছে। গ্রামীণ জনপদের উপর দিয়ে প্রবাহিত এসব নদী ও খালের বেশিরভাগ অংশে রয়েছে টয়লেটের ময়লার লাইন। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত পোল্ট্রি ফার্মের ময়লা ফেলা হচ্ছে নদী-খালে। পানিদূষণে এসব নদী ও খালের মাছ মারা যাচ্ছে। ব্যাঘাত ঘটছে মাছের প্রজননে।

 

পানি দূষণ ছাড়াও উপজেলার অর্ধশত ইটভাটার কালো ধোঁয়া ও বর্জ্যে ফটিকছড়ির পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। এতে ইট ভাটার আশপাশের এলাকার মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে। দূষণরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে এসব এলাকার বাসিন্দারা; বিশেষ করে শিশু-বয়স্করা মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

জায়গা দখলের মহোৎসব :

হাটহাজারীতে চলছে সড়ক ও জনপথ, জেলা পরিষদ এবং রেলওয়ের কোটি টাকার জায়গা দখলের মহোৎসব। বিশেষ করে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আবারও এসব দখলের আড়ালে কোটি টাকার বাণিজ্যে মেতে উঠেছে একটি ভ‚মিদস্যু স্বার্থান্বেষী মহল। অভিযোগ রয়েছে সরকারি সম্পদ দখলের মহোৎসব চললেও রহস্যজনক কারণে নীরব ভ‚মিকা পালন করছে কর্তৃপক্ষ।

 

জানতে চাইলে সওজ’র চট্টগ্রাম জেলার প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন বলেন, সড়কের জায়গা ভরাট করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে হাটহাজারীর ইউএনও এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, যেহেতু সম্পদগুলো সড়ক ও জনপথ বিভাগের সেহেতু তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে সাহায্য চাইলে আমরা সহযোগিতা করবো।

 

হারাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য :

অবৈধ বালি ও মাটি পাচারকারীদের অবাধ লুটপাটের কবলে পড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে ফটিকছড়ির প্রাকৃতিক ভারসাম্য। বালি ও মাটি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন দফায় দফায় অভিযান চালালেও কোনো কাজ হচ্ছে না। উল্টো প্রশাসনের সাথে কানামাছি খেলছে পাচারকারীরা। বেপরোয়া বালি তোলার কারণে বর্ষায় খাল ও নদীর পাড় ভেঙে ফটিকছড়িতে বন্যা হচ্ছে।

 

অবাধে চলে পাহাড় কাটা :

শুষ্ক মৌসুমে রাউজানে সন্ধ্যা নামলেই চলে পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতা। অসাধু ব্রিকফিল্ড মালিকরা পাহাড়-টিলার মাটি কেটে ইট তৈরি করেন। পাহাড়ের মাটি বিক্রি করেই স্থানীয় অনেক প্রভাবশালী রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। পাহাড়-টিলার মাটির সঙ্গে গাছ কেটে অনেক বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

 

সংকুচিত হচ্ছে গুমাই বিলের পরিধি :

চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার খ্যাত রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলের পরিধি সংকুচিত হচ্ছে দ্রুতগতিতে। গুমাই বিলের বিভিন্ন অংশের আবাদি জমিতে বসতঘর নির্মাণ করা হচ্ছে ব্যাপকহারে। অবকাঠামো নির্মাণের কারণে গুমাই বিলে কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় আমন ও বোরো মৌসুমে অন্তত ৩০ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

অনুমোদনবিহীন ইট ভাটার ‘রাজত্ব’ :

প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সনদ্বীপে মহাসমারোহে চলছে অবৈধ ইটভাটা। বনভূমি ও কৃষি জমিতে স্থাপন করা ১৬টি ইটভাটার মধ্যে ১৫টিরই অনুমোদন নেই। ইটভাটার চুল্লির বিষাক্ত ধোঁয়া প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করে চলছে। ভাটার আশপাশের জমির ঊর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। সেখানে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না।

 

অবৈধ ইটভাটা সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, সন্দ্বীপ উপজেলায় অবৈধভাবেই ইট ভাটা চলছে। আমরা ২০১৮ সালে অভিযান পরিচালনা করে সব ভেঙে দিয়েছিলাম। কিন্তু আবারও তারা ইট ভাটাগুলো চালু করেছে। আইনগত ব্যবস্থা নেব আমরা।

 

হুমকিতে হালদার জীব-বৈচিত্র্য :

দূষণের কারণে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। দূষণে এ নদীর ডলফিন মারা যাচ্ছে একের পর এক। মৃত্যু হচ্ছে মা মাছসহ বিভিন্ন প্রকারের মাছের। বিভিন্ন খালের মাধ্যমে শহরের কারখানার বর্জ্য হালদা নদীতে এসে পড়া, হালদা পাড়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যরে কারণে এ নদী দূষিত হয়ে পড়ছে বলে গবেষকরা মনে করছেন।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট