চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

প্রযুক্তিপণ্যে শিশুদের আসক্তি ও ক্ষতি

রেজা মুজাম্মেল

১৪ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:০৯ পূর্বাহ্ণ

কোমলমতি শিশু পরিবারের সবার আদর-আহ্লাদে বড় হবে। কখনো মায়ের কোলে, কখনো বাবার কোলে, কখনো ভাইবোনের কোলে, কখনো দাদা-দাদীর কোলে। পরম আনন্দ ও ¯েœহে বড় হয়। মমতা নিয়ে দিন পার করে। ক্রমশ বড় হয়। নান্দনিকতা, ভাললাগা আর ভালবাসার তরীতে ভর করে শিশুর আগামীর গঠন তৈরি হয়। শিশুবান্ধব একটি পরিবেশেই সময় পার করে। আলিঙ্গন করে হৃদ্যতা। সঙ্গে থাকে ভাললাগার যত সব অনুষঙ্গ। এমন পরিবেশ, এমন ইতিবাচক আশ্রয়ে একটি শিশু বড় হবে, এমনটি প্রত্যাশা সকল মা-বাবার। বাস্তবেও তা হওয়া উচিত।

কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? বর্তমানে পরিবার ও সমাজের বাস্তব চিত্র কী? নিকট অতীতের পরিবার-সমাজ চিন্তার সঙ্গে কি কোনো মিল বা সম্পৃক্ততা কি খুঁজে পাওয়া যায়। এমন নির্মল, হৃদ্যতা এবং আন্তরিক পরিবেশ কি অবশিষ্ট আছে। পরিবার-সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে কী দৃশ্যমান হচ্ছে। ব্যক্তিগত চরিত্র, পারিবারিক অবস্থা এবং সামাজিক চিত্র কী বার্তা দিচ্ছে। কখনো কেউ কি একবারের জন্যও চিন্তা করেছেন। মনে হয়, এ চিন্তা করার সময় বা ফুরসত কিংবা মানসিকতা আমাদের নেই। প্রযুক্তি নামক বিষয়টি আমাদের জীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রে যে হারে জেঁকে বসেছে, তা থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ বা বিকল্প মাধ্যম নেই। বরং প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তি যথেষ্ট সদ্ব্যবহার, বলা যায় যথাযথ ব্যবহার। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়তই যারপরনাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছি। প্রযুক্তিপণ্যের এ ব্যবহার থেকে শিশু-কিশোর, তরুণ, আবাল বৃদ্ধ বণিতা কেউ বাদ যাচ্ছে না। তবে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিশু-কিশোরদের অত্যন্ত সচেতনভাবে দূরে রাখার কোনো বিকল্প নেই। প্রযুক্তির উপকরণগুলো কোনো মতেই শিশু কিশোরদের নাগালের মধ্যে রাখা উচিত নয়। পক্ষান্তরে এখন চলছে ডিজিটাল বিপ্লবের সময়। এই সময়ে শিশুর জন্য বাস্তব জগত ও ভারচুয়াল জগতের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ জরুরি। সন্দেহ নেই, প্রযুক্তি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের জন্য আশির্বাদ। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষ, ব্যবহারকারীর চিন্তা-চেতনা এবং মানসিকতার কারণে এই প্রযুক্তি যে আমাদের জন্য অভিশাপ হচ্ছে না, তা কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না। ফলে বর্তমান সময়ে ব্যবহারের শীর্ষে থাকা মোবাইল, ভিডিও গেম, ট্যাব, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারসহ নানা প্রযুক্তি পণ্য আমাদের জীবনে আশির্বাদের পরিবর্তে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। এটি কেবল প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারীর মানসিকতার ওপর নির্ভর করে।

কোনো পরিবারে মা বাবা দুইজনই চাকরিজীবী। এক্ষেত্রে সন্তানটি অনেকটা কাজের মেয়ে বা অন্য কারো ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া সারাদিন সন্তানের সময় কাটে টেলিভিশনে কার্টুন দেখে কিংবা মোবাইল বা ট্যাবে গেমস খেলে। পুরো দিনটিই এই সন্তানটি মা বাবার ¯েœহ থেকে বঞ্চিত। বিকাল, সন্ধ্যা কিংবা রাতে বাসায় ফিরে কেউ পারিবারিক নানা কাজ, কখনো সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে যান। সবশেষে রাতে ঘুমানোর পালা। এমন অবস্থায় ওই পরিবারের সন্তানরা মা-বাবাকে কতটুকু কাছে পায়, সে প্রশ্নও সামনে আসে। উপরন্তু চমকপ্রদ এবং ভিন্নধর্মী এক পরিবারের অভিজ্ঞতা এখানে প্রাসঙ্গিক। এক পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুইজনই পেশাজীবী। বাসায় সময় দেওয়ার এতটুকু ফুরসত তাদের নেই। তাই তাদের বাসায় লাগানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। কর্মস্থল থেকেই সারাদিন বাসা নিজ নজরে রাখা হয়। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পরিবারের সবার প্রতি দৃষ্টি রাখা হয়। এখানে পরিবারে তদারকি করার চেয়ে বড় প্রশ্ন- সন্তানরা কতটুকু মা-বাবার সাহচার্য পাচ্ছে কিংবা আদৌ পাচ্ছে কিনা।

শিশু প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ার নানা কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো শিশুদের খেলার উপযোগী মাঠের চরম অভাব এবং প্রযুক্তি পণ্যের সহজলভ্যতা। তদুপরি, শিশুরা প্রযুক্তি হাতে পেলেও তা ব্যবহারে যথাযথ তদারকি না থাকা। ফলে শিশুরা অতিরিক্ত সময় ধরে প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন শিশুরা দৈনিক কমপক্ষে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে টিভি দেখে কিংবা কোনো প্রযুক্তিপণ্যে গেম খেলে বা টিভি দেখে সময় কাটায়। শিশুরা অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবার ব্যবহৃত প্রযুক্তিপণ্যের পাসওয়ার্ড পর্যন্ত জেনে যায়। তবে প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারের কিছু শিক্ষণীয় দিকও রয়েছে বলে মনে করেন গবেষকেরা। এখনকার শিশুরা প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করে কোনো কিছু শেখা, ধাঁধা সমাধান করা, শব্দভান্ডার বাড়ানোর মতো বিষয়গুলো শিখতে পারে। বলা যায় শিক্ষার একটি মাধ্যমও প্রযুক্তিপণ্য। কিন্তু তার ব্যবহার হতে হবে সীমিত এবং প্রয়োজন ভিত্তিক। আমেরিকান একাডেমিক ও পেডিয়াট্রিকস বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনোভাবেই প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে দেওয়া উচিত নয়। তাদের সামনে প্রযুক্তিপণ্য উন্মোচন করাও ঠিক নয়। শিশুর বয়স তিন থেকে পাঁচ বছর হলেই দৈনিক বড়জোর এক ঘণ্টা প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত। তাছাড়া বর্তমান সময়ের শিশুদের প্রযুক্তি পণ্য কেন্দ্রিক আচরণ পর্যালোচনা করে গবেষকেরা বলছেন, এখনকার শিশুরা প্রযুক্তিপণ্যে এতটাই আসক্ত হয়ে যাচ্ছে যে, শিশুর হাত থেকে মোবাইল ফোন বা ট্যাব কেড়ে নিলে তারা রেগে যাওয়া, কোনো কিছু ছোড়ে মারা ও খাবার না খাওয়াসহ নানা নেতিবাচক আচরণ শুরু করে। তারা অন্য কোনো দিকে খেয়ালই করে না। কারও সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। তারা মোবাইল ও ট্যাবে চোখ রাখে বেশি সময় ধরে। এর নানা নেতিবাচক প্রভাবও পড়ছে পরিবার ও সমাজে। পরিবর্তন আসছে পারিবারিক বন্ধনে। মনস্তাত্ত্বিকরা মনে করছেন, প্রযুক্তিপণ্য শিশুদের মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে। অনেক শিশু এখন ট্যাব, স্মার্টফোনে গান না শুনে কিংবা ভিডিও না দেখে খাবার খেতেই চাইছে না। এসব কারণে অভিভাবকের থেকে শিশু-কিশোরদের দৃষ্টিকোণ অন্যদিকে ফিরে যাচ্ছে। প্রযুক্তির নানা পণ্য বাস্তব জগতের যোগাযোগের মধ্যে তৈরি করে দিচ্ছে দেয়াল। তবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা জরুরি ভিত্তিতে শিশুদের ক্ষেত্রে দৃষ্টি রাখা উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছেন। এর মধ্যে আছে, দেড় বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার করতে না দেওয়া, ভিডিও চ্যাট করতে না দেওয়া, টিভি বা অন্য কোনো স্ক্রিনে মানসম্মত অনুষ্ঠান দেখতে উৎসাহ দেওয়া, ঘুম বা খেলার সময় কোনো মতেই যেন প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার না করা এবং দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের দিনে এক ঘণ্টার বেশি প্রযুক্তি পণ্য দেখতে না দেওয়া। পক্ষান্তরে এখন দাবি উঠছে, শিশুদের জীবন নিরাপদ রাখতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর শিশু বান্ধব প্রযুক্তি তৈরি করার।

প্রশ্ন ওঠে- শিশুদের হাতে মোবাইল দেয়া কি খুব জরুরি।

যদি দিতে তাহলে কখন কোন বয়সে দিতে হবে। এ প্রশ্নে হয়তো নানা উত্তর আসবে, উত্তরে ভিন্নতা থাকবে। সন্তানকে মোবাইল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অভিভাবককে কিছু বিষয় বিবেচনা করা জরুরি। সন্তানের হাতে মোবাইল দেয়া কি জরুরি, মোবাইলের চাহিদা আছে কিনা, নাকি অন্যদের আছে বলে সন্তানের আবদার মেটাতে মোবাইল দেয়া। এর সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার- শিশুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ম-কানুন। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোবাইল ফোনের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে, কোথাও নিয়ম মেনে মোবাইল ব্যবহার করতে দেওয়া হয়, আবার কোথাও মোবাইল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ। তবে শিশুকে মোবাইল দেওয়ার আগে সন্তানের আচরণের বিষয়টি খুব সচেতনভাবে মনে রাখতে হবে। অন্যদিকে, সন্তানের হাতে পুরস্কার হিসেবে মোবাইল ফোন দিলে সে আরও বেশি দায়িত্বশীল ও উদ্যমী হলে, সন্তান লেখাপড়ার কাজে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়লে এবং মা-বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ রাখতে মোবাইল দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যায়।

কিন্তু সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার আগেই অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়টি।
প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার জরুরি নাকি সন্তানের নিরাপত্তা জরুরি। বর্তমান বাস্তবতায় বিষয়টি সামনে আসে। প্রযুক্তির আসক্তির কারণে যদি সন্তানের ক্ষতি হয়, তাহলে এ প্রযুক্তি প্রজন্মের জন্য আশির্বাদের পরিবর্তে অভিশাপে পরিণত হয় বৈকি। আমরা চাই, প্রযুক্তি কারো জন্য অভিশাপ না হোক, আশির্বাদই হোক। এর জন্য প্রয়োজন মা-বাবার সতর্কতা, সচেতনতা ও সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীলতা। সন্তানের ওপর যেন প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। প্রযুক্তি নয়, মা-বাবাই হোক সন্তানের প্রকৃত বন্ধু, আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক।

রেজা মুজাম্মেল গণমাধ্যমকর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট