চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

গোলটেবিল বৈঠকে ভূমিমন্ত্রী

মৃত্যুর পথে কর্ণফুলী, বাঁচাতে প্রয়োজন এখনই পদক্ষেপ

‘কথা দিচ্ছি, সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো’

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৩ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:৪৩ পূর্বাহ্ণ

‘কর্ণফুলী নদী অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং এই নদীকে ঘিরে সরকারের অনেক পরিকল্পনাও রয়েছে। এই নদীকে বাঁচাতে ড্রেজিং থেকে শুরু করে যা যা করা প্রয়োজন তা করতে আমি সহযোগিতা করবো। কর্ণফুলীর বর্তমান চিত্র ভয়াবহ। এভাবে যদি চলতে থাকে অদূরভবিষ্যতে এ নদী থাকবে কিনা আমার সন্দেহ আছে’। গতকাল (শনিবার) দুপুরে নগরীর অভয়মিত্র ঘাটে ‘কর্ণফুলী নদীর দখল ও দূষণমুক্তসহ

অবিলম্বে পরিকল্পিত ক্যাপিটাল ড্রেজিং’ এর মাধ্যমে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আনার লক্ষ্যে করণীয় শীর্ষক গোল গোলটেবিল আলোচনায় ভূমিমন্ত্রী এসব কথা বলেন। কর্ণফুলীকে বাঁচাতে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ^াস দিয়ে মন্ত্রী বলেন, মন্ত্রী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে আছি। আমি আজ মন্ত্রী আছি, কাল নাও থাকতে পারি। কিন্তু চট্টগ্রামবাসীর প্রতি আমার দায়বদ্ধতা আছে, যেহেতু আমি চট্টগ্রামের সন্তান। কথা দিচ্ছি, কর্ণফুলীকে বাঁচাতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো।

ভূমি মন্ত্রী আরো বলেন, অব্যাহত দখলের পর কর্ণফুলী নদী এখন যে অবস্থায় আছে, আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এই নদীর আর কোনো ক্ষতি করার সুযোগ কাউকে দেওয়া যাবে না। আমি পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে নদী উদ্ধারের কাজ শুরু করেছিলাম। আইনের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, হাইকোর্টের নির্দেশনার কারণে মাঝপথে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় আমি চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে প্রত্যাশা করছি যে, এই নদীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তারা এগিয়ে আসবেন।

বন্দরের চেয়ারম্যানের উদ্দেশ্যে মন্ত্রী বলেন, বন্দরের প্রাণ হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। আপনি বন্দর ব্যবহারকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বসেন। দখল ও দূষণ রোধ করা এবং এই নদীর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। একটা স্থায়ী রূপরেখা তৈরি করেন। পরবর্তী চেয়ারম্যান এসে যাতে এই রূপরেখা অনুসরণ করতে পারেন। আপনি আজ চেয়ারম্যান আছেন, কাল নাও থাকতে পারেন। ড্রেজিং তো নিয়মিত করতে হবে।

কর্ণফুলী নদীজুড়ে লাইটারেজ জাহাজ ছড়িয়ে থাকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, সাগরে অনেক জায়গা। লাইটারেজ জাহাজগুলো নদীতে কেন পার্ক করে রাখা হবে। আগে দেখতাম শুধু খারাপ আবহাওয়া হলে লাইটারেজগুলো নদীতে এনে রাখা হত। এখন তো সারাবছর ফিরিঙ্গি বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। এতে তো বন্দরে বড় জাহাজ চলাচলে সমস্যা হয়। নেভিগেশনের সমস্যা হয়। এতে প্রয়োজনে বন্দর কর্তৃপক্ষকে কোস্টগার্ডের সহযোগিতা নিতে বলেন মন্ত্রী।
চ্যানেল আইয়ের ২১ বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে আয়োজিত গোল টেবিল বৈঠকের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিনিয়র সাংবাদিক ও কর্ণফুলী বাঁচাও আন্দোলনের উদ্যোক্তা আলীউর রাহমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন চ্যানেল আই’র চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান চৌধুরী ফরিদ।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, কর্ণফুলী নদী কী কারণে দূষিত হচ্ছে আমরা কম-বেশি সবাই জানি। কর্ণফুলী আমাদের অস্তিত্ব। কর্ণফুলীকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। সবাই যার যার অবস্থান থেকে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে দখল-দূষণ থেকে কর্ণফুলী নদী রক্ষা পাবে। কর্ণফুলীর জন্য অনেকে বন্দরকে দায়ী করেন। ক্যাপিটাল ড্রেজিং তো করতে পারছে না। পলিথিনের লেয়ার জমে গেছে। কোনো মেকানিজম কাজ করছে না। তাই নাগরিকদের ভূমিকা বেশি। জনসচেতনতা প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়াল এডমিরাল জুলফিকার আজিজ বলেন, ‘কর্ণফুলীর সাথে বন্দর জড়িত। কর্ণফুলী না থাকলে বন্দর থাকবে না। কর্ণফুলী নদীতে এক নম্বর জেটি অর্থাৎ নিচের দিকে নাব্যতা অনেক বেড়েছে। কিন্তু উপরের দিকে নাব্যতা কমেছে। আমরা নিয়মিত ড্রেজিং করছি বলেই নাব্যতা বেড়েছে। উপরের দিকে করতে পারছি না, সেখানে অনেক প্রতিবন্ধকতা। সেখানে নদীর তলদেশে মাটি নেই, সব আবর্জনা, পলিথিন। প্রতিদিন টনে টনে বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে। আমরাও একমত যে কর্ণফুলী নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে।

বন্দর চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘কর্ণফুলী নদী আঁকাবাঁকা। এটাকে স্ট্রেইট করতে না পারলে জাহাজ চলাচলে সমস্যা থেকে যাবে। আমরা স্ট্যাডি করছি। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা যেটা হচ্ছে, অনেককিছুই ভাঙতে হবে। কারখানা বা স্থাপনাগুলো কোথায় প্রতিস্থাপন করা হবে, তাদের যেন ক্ষতি না হয় সেটাও আমাদের মাথায় রাখতে হচ্ছে।
সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, ৪০০-৫০০ বছর আগে কর্ণফুলী নদী ছিল কোর্ট বিল্ডিংয়ের নিচে পর্যন্ত, তা এখন ভরাট হতে হতে এ পর্যায়ে এসেছে। কর্ণফুলী নদী দিয়ে দেশের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। কর্ণফুলীকে বাঁচাতে যদি ৬ মিটার খনন করতে হয় তবে উন্নত ড্রেজার আনতে হবে। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতা বেশি।

চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এ. কে. এম ফজলুল্লাহ বলেন, কর্ণফুলী দূষণের অনেকগুলো কারণের মধ্যে হচ্ছে, লাইটার জাহাজ ও ট্রলারের বর্জ্য নদীতে ফেলা। এছাড়া কলকারখানা ও গৃহের বর্জ্য তো আছেই। জোয়ার-ভাটার কারণে এই নদী এখনো ঠিকে আছে। না হয়, অনেক আগে কর্ণফুলী নদী নষ্ট হয়ে যেত। জলাবদ্ধতার উপর আমরা একটা মাস্টার প্ল্যান করেছি, সে অনুযায়ী যদি কাজ করা হয়, তাহলে অনেকটা লাভ হবে।

দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম. এ মালেক বলেন, কর্ণফুলী হচ্ছে বাংলাদেশের ফুসফুস। কর্ণফুলী বাঁচাতে হবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজেদের বাঁচাতে হলে পারিপার্শ্বিক সব কিছুতে লক্ষ্য রাখতে হবে। সচেতন হতে হবে। তাহলে দেশ ও জাতি বাঁচবে।

চ্যানেল আই চট্টগ্রামের ব্যুরো প্রধান চৌধুরী ফরিদের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরো অংশ নেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দেলোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া, কর্ণফুলী নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী, ব্যবসায়ী নেতা এস এম আবু তৈয়ব ও এম এ সালাম, স্থপতি আশিক ইমরান, সাইফ পাওয়ার টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রহুল আমিন, কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব প্রমুখ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট