চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দারিদ্র্যের মাঝেও রশীদুলের সঙ্গী বই

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১২ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:৩১ পূর্বাহ্ণ

চেরাগির মোড়ে বুক মার্ক বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারতেই চোখ আটকে গেল। লুঙ্গি পরা-মাথায় গামছা বাঁধা এক যুবক। তার হাতে ডাউস সাইজের একটি বই। তাও বিদেশি লেখকের। ডেল কার্নেগী’র বইটির মর্মার্থ বর্ণনা করছিলেন পাশের জনদের। পাশেরা তিনজনই শিক্ষাবিদ-লেখক। যুবকটির নাম রশিদুল ইসলাম। তিনি পেশায় রিকশাচালক। বাড়ি নওগাঁ জেলার ধামইরহাটের মহেশপুরের আগ্রাদ্বিগুন বাজার এলাকায়। রিকশা চালান নগরীতে। থাকেন নগরীর টাইগারপাসের বালুরমাঠ এলাকায়। পরিবার-পরিজন থাকে নওগাঁ গ্রামের বাড়িতে। রশিদুল ইসলাম ২০০৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। এক বিষয়ে ফেল করলে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ফেলতে হয়। ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন দিনমজুরি করে। বিয়ে করেছেন ২০০৩ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর। বইয়ের দোকানেই আলাপ হয় রশিদুলের সাথে। তিনি বলেন তার নেশা হচ্ছে বই কেনা, বই পড়া আর লেখালেখি। রশিদুল ইসলাম বলেন, প্রাইমারি স্কুলে পড়া থেকে বই পড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল। প্রতিবেশী সোলায়মান আলী তাকে বই, ম্যাগাজিন দিতেন। মাটি কাটার কাজ, দিনমজুর ও ক্ষেত-খামারে কাজ করে পড়াশোনা চালিয়েছেন তিনি। প্রতিমাসে কিছু টাকা সঞ্চয় করে একটি করে বই কিনেন। সেই নিয়মটা এখনো রয়েছে। তবে বর্তমানে বই ছাড়াও ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিনেন।

হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর কিভাবে পড়াশুনা সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব কিছু রুটিন মাফিক। প্রতিদিন দু-তিন ঘণ্টা বই পড়েন। বাসায় পড়ার পরিবেশ বা সুযোগ না পেলে রাস্তায় বসে পড়েন। কর্পোরেশনের বাতিতে পড়েন। বইয়ের দোকানে তিন শিক্ষাবিদের সঙ্গে জমে ওঠা আড্ডার ফাঁকে রশিদুল পাঠ করলেন নিজের লেখা একটি কবিতাও। এক মহিলা লেখিকাও আবৃত্তি করলেন কয়েক

পঙক্তি। তার লেখা একটি বই উপহার দিলেন সেই রিকশাচালককে। বিখ্যাত লেখক ডেল কার্নেগীর লেখা বই কেন পড়েন এমন প্রশ্নের জবাবে রাশিদুল বলেন, ডেল কার্নেগীর লেখা আটটি বইয়ের সব বই তার পড়া হয়েছে। প্রতিটি বই হচ্ছে বাস্তব-জীবনধর্মী।

বাতিঘরের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান চেরাগীপাহাড় মোড়ের বুকমার্কের সঞ্জয় সূত্রধর জানালেন, ‘রিকশাচালক রশিদুল ইসলাম প্রায়ই তার দোকানে আসেন। বই পড়েন, বই কিনেন।’

তার লেখা ৫০টি কবিতা সম্পাদনা করে দিয়েছেন নওগাঁ সদর ফয়েজ উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের প্রফেসর ড. আইয়ুব আলী। সাহিত্য চর্চা ও লেখালেখিতে উৎসাহ জুগিয়েছেন ড. আইয়ুব আলী ও স্কুল শিক্ষক (বর্তমানে অবসর) গোলাম মোস্তফা।
ড. আইয়ুব আলী পূর্বকোণকে বলেন, ‘রিকশাচালক হলেও রশিদুলের মধ্যে সাহিত্যের সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে। নিরলসভাবে লেখালেখি চর্চা করলে একদিন তার স্বীকৃত পাবেই সে।’

রশিদুল আরো বলেন, এ পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি বই সংগ্রহে রয়েছে। সব বই-ই পড়া হয়েছে। দারিদ্র্য আর অভাবের পরও বই কেনার নেশার বুঁদ কাটেনি তার। বিদেশি লেখকের অনুবাদের বই থেকে শুরু করে লালন, বরীন্দ্রনাথ, নজরুলের বই পড়েন। পড়েন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ুন আহমেদের বই বেশি পড়া হয়েছে তার।

রিকশা চালানো অমানবিক ও মানবতাবিরোধী পেশা বলে উল্লেখ করে রশিদুল বলেন, ‘কোন বুড়ো চাচা যখন রিকশা চালান, তখন তরুণ, ছাত্র ও শিক্ষিত লোক রিকশায় চড়তে চান না। মানুষ মানুষকে টানে-এই ধরনের পেশা পৃথিবীর কোনো দেশে নেই।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট