চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সৃজনশীলে ‘ভয়’ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর

ষ আগামীকাল থেকে চট্টগ্রামে সৃজনশীল প্রশিক্ষণ শুরু ষ অনেক শিক্ষকই বুঝেন না সৃজনশীল পদ্ধতি

ইমরান বিন ছবুর

১১ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:১৫ পূর্বাহ্ণ

সৃজনশীল পদ্ধতির ১০ বছর পার হলেও শিক্ষার্থীর পাশাপাশি এখনো অনেক শিক্ষকই এই পদ্ধতি ভালোভাবে বুঝেন না। তাই এখনো অধিকাংশ শিক্ষার্থী গাইড বইয়ের উপর নির্ভরশীল। এছাড়া, অনেক শিক্ষক গাইড বই দেখে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মফস্বল এলাকার শিক্ষার্থীদের। সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরির বিষয়ে দক্ষ শিক্ষকের সংকট সেখানে তীব্র। অথচ গাইড বই এবং মুখস্ত বিদ্যা থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনতে ২০০৮ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়। অধিকাংশ শিক্ষক সৃজনশীলের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও তা নাম মাত্র প্রশিক্ষণ বলে স্বীকার করেছেন চট্টগ্রামের একাধিক স্কুলের শিক্ষক। মাত্র তিন দিনের এই প্রশিক্ষণে সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করা সম্ভব না বলে জানান তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রামে শিক্ষকদের মাঝে সৃজনশীলের উপর প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। এছাড়া, পূর্বে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে তা ছিল মাত্র তিনদিনের। মাত্র তিনদিনের প্রশিক্ষণে সৃজনশীল বুঝা বা পরীক্ষায় প্রশ্ন করা কোন ভাবেই সম্ভব না। শিক্ষকরা নিজেরাই যদি ভালোভাবে বুঝতে না পারেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের কিভাবে বুঝাবে এবং কিভাবে সৃজনশীল প্রশ্ন করবে।

তিনি আরো বলেন, মূলত যারা ১২ দিনের মাস্টার ট্রেনিং নিয়েছে তারাই সৃজনশীলের উপর তিনদিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। ট্রেইনাররা নিজে কতটুকু সৃজনশীল বুঝেন সেটাও ভাবার বিষয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সৃজনশীলের উপর মাস্টার ট্রেইনারের সংখ্যা খুব কম। যেগুলো আছে, উনারা হচ্ছেন তিনদিনের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। আমি নিজেও একজন মাস্টার ট্রেইনার। কিন্তু আমার নিজের মনে হয় আমি নিজেও ভালোভাবে সৃজনশীল বুঝি না। তাহলে তিনদিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষকরা কি বুঝবে। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের পরিচালক প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্তী জানান, সৃজনশীলের প্রশিক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। সৃজনশীল প্রশিক্ষণ ছাড়া তো শিক্ষার্থীদের পড়ানো সম্ভব না। শিক্ষকতা পেশায় যোগ দান করা নতুন শিক্ষকরা কিন্তু এই প্রশিক্ষণ পায়নি। এছাড়া, যারা সৃজনশীলের উপর মাস্টার ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে তাদের অনেকেই এখন শিক্ষকতা পেশাই নেই। সৃজনশীল প্রশিক্ষণের জন্য আমরা বিভিন্ন সময় সরকারকে বলেছি। আমাদের শিক্ষা উপ-মন্ত্রীকে বলাতে অবশেষে তিনি সৃজনশীলের উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রামে এরপর আর কোন মাস্টার ট্রেনিং হয়নি। আগামীকাল শনিবার থেকে তিনদিনের সৃজনশীলের উপর প্রশিক্ষণ শুরু হবে। চট্টগ্রাম জেলার ২০০ জন শিক্ষক এই প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পাবে।

সর্বশেষ ২০১০ সালে চট্টগ্রামে সৃজনশীলের উপর মাস্টার ট্রেনিং হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার মো. জসিম উদ্দিন জানান, আগামীকাল শনিবার থেকে চট্টগ্রাম জেলার ২০০ জন শিক্ষককে সৃজনশীলের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) প্রকল্পের আওতায় এবং ছাড়া মাউশি অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখা থেকে সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তিনদিনের এই প্রশিক্ষণে বাংলা, গণিত, বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ^ পরিচয় ও ব্যবসায় শিক্ষার উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পর্যায়ক্রমে মোট ২৩টি বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড ও জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, ‘সৃজনশীল প্রশিক্ষণের জন্য প্রথমে মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হয়। মূলত এই মাস্টার ট্রেইনাররাই শিক্ষকদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, মাস্টার ট্রেইনাররাই নিজেরা ঠিকমতো সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না। তাহলে তাঁরা কিভাবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এছাড়া অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন এবং খ-কালীন শিক্ষক রয়েছেন, যারা সৃজনশীলের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি। কিন্তু তারাও সৃজনশীল পদ্ধতিতে পড়াচ্ছেন। এ কারণে ১০ বছর পার হওয়ার পরও জোড়াতালি দিয়েই চলছে সৃজনশীল পদ্ধতি।’

গত বছর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মনিটরিং শাখার ‘একাডেমি তদারকি প্রতিবেদন’ জানিয়েছে, মাধ্যমিক স্কুলের ৫৪ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। তাঁদের ২২ শতাংশের অবস্থা খুবই নাজুক। বাকিরা এ সম্পর্কে যে ধারণা রাখেন, তা দিয়ে আংশিক প্রশ্নপত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। আর উচ্চ মাধ্যমিক স্থরেও প্রায় একই চিত্র পাওয়া গেছে।

জানা যায়, ২০০৪ সালে প্রথম এ পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত করতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তখন এর নাম ছিল কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নেতৃত্বে গড়ে উঠা আন্দোলনের মুখে ২০০৬ সালে সরকার আর একমুখী শিক্ষা চালু করতে পারেনি। পরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের উদ্যোগে দেশের শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে এ পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ২০০৭ সালের জুনে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের সরকারি আদেশ জারি হয়। ২০০৮ সাল থেকে পদ্ধতিটি নবম শ্রেণীতে চালু হয়। ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম প্রবর্তন ঘটে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট