চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইউসুফ চৌধুরীর স্বাধীনতা ও একুশে পদক সময়ের দাবি

বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির স্মরণ সভায় অভিমত

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:২৯ পূর্বাহ্ণ

মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর মত মানুষের কখনোই মৃত্যু হয় না। দৈহিকভাবে মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর কীর্তি রয়ে গেছে। চট্টগ্রামের ইতিহাসের সাথে ইউসুফ চৌধুরী অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ৫০ এর দশক থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাসের এই অংশে ইউসুফ চৌধুরী ছাড়া চট্টগ্রামের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন কালজয়ী পুরুষ। তাঁকে জাতীয় স্বীকৃতি দেয়া সময়ের দাবি। তাঁর জাতীয় স্বীকৃতি অর্জনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে। তাঁর অবদানগুলো লিপিবদ্ধ করে সরকারের কাছে তুলে ধরার জন্য একটি কোর কমিটি গঠন করতে হবে।

গতকাল রবিবার পূর্বকোণ সেন্টারের ইউসুফ চৌধুরী কনফারেন্স হলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে দৈনিক পূর্বকোণ’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি স্থায়ী পরিষদের সাবেক সভাপতি চট্টলদরদী মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি ডা. শেখ শফিউল আজমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার উদ্বোধন করেন বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি স্থায়ী পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ জসিমউদ্দিন চৌধুরী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. ইসমাইল খান, চুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল আলম, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনূস, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এ- এনিমেল সাইন্সেস বিশ^বিদ্যালর সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুদ্দিন, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সেকান্দর চৌধুরী, বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, সাবেক সাংসদ ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির স্থায়ী পরিষদের সদস্য সাবিহা মূছা, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এ- ই-াস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি লায়ন নাজমুল হক মিয়া, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এ- ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ, এডভোকেট আবু নাসের তালুকদার। সভা পরিচালনা করেন বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির মহাসচিব এইচ এম মুজিবুল হক শুক্কুর।

চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. ইসমাইল খান বলেন, মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী ছিলেন একজন কালজয়ী মহাপুরুষ। একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদকের পাওয়ার জন্য তিনি অত্যন্ত যোগ্য। কিভাবে সেটা অর্জন করা যায় সেই বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। আমরা সবাই অন্তর থেকে সেই কথাটি অনুভব করছি। একথা সত্য আমাদের মনের সংকীর্ণতার কারণে গুণী ব্যক্তিদের আমরা স্মরণ করি না। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ইউসুফ চৌধুরী শুধু চট্টগ্রামের জন্য অবদান রেখেছেন তা নয়। তাঁর অবদানে সারাদেশ উপকৃত হচ্ছে। আমাদের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পূর্বকোণ মানেই নতুন কিছু। শুরু থেকেই সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভেটেরিনারি, মেডিকেল সবকিছুর ভবিষ্যৎ উন্নয়নের বিষয়ে তিনি ভিশনারি লিডার। তাঁর মধ্যে সবাইকে একসাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্যারিশমা ছিল।

এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, রাজনীতির একটা অন্ধকার সময় যখন ক্ষমতায় ছিল আইয়ুব খান। সেসময় প্রভুত্বশীল রাজনীতির বিপরীতে কাজ করেছিলেন ইউসুফ চৌধুরী। তখন কলকাতা থেকে পত্রিকা আসতো। তাঁর নিউজফ্রন্টে বই পড়ার জন্য অনেক বিদগ্ধ লোকজন সেখানে যেতেন। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করা, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির চিন্তাকে একটি প্রাজ্ঞসর চিন্তায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন। ভেটেরিনারি বিশ^বিদ্যালয় আন্দোলনের সুচনা করার সাথে সাথে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্তরের গুণীজনদের তিনি সম্পৃক্ত করেছিলেন। মানুষের জন্য কাজ করা, দেশের জন্য কাজ করার প্রবণতা তার মধ্যে ছিল। অনেককেই তিনি গোপনে সাহায্য করতেন। তিনি ছিলেন মানবদরদী। চট্টগ্রামের ইতিহাসের সাথে ইউসুফ চৌধুরী অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ৫০ এর দশক থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাসের এই অংশে ইউসুফ চৌধুরী ছাড়া চট্টগ্রামের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন কালজয়ী পুরুষ।

ড. রফিকুল আলম বলেন, আধুনিক ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম উন্নয়নের জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন ইউসুফ চৌধুরী। ইচ্ছা শক্তি ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে সাহিত্য এবং প্রকাশনা শিল্পে নিজেকে সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। পত্রিকার মাধ্যমে চট্টগ্রামে একটি ভিন্নধারা সৃষ্টি করেছেন। তার অনেকগুলো অবদানের মধ্যে সবচেয়ে বড় অবদান ভেটেরিনারি বিশ^বিদ্যালয়। প্রথমে কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে মাত্র নয় বছরের মাথায় কলেজকে তিনি বিশ^বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেছেন। প্রতিষ্ঠার ৩৫ বছর পর চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে বিশ^বিদ্যালয় রূপান্তরেও অবদান রেখেছেন। এমন একজন গুণী মানুষকে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি দেয়া বর্তমান সময়ের বড় দাবি। তাঁকে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া উচিত।
ড. এ কে এম সাইফুদ্দীন বলেন, তাঁকে শুধুমাত্র চট্টলদরদী বললে ভুল হবে। কারণ তিনি ছিলেন মানবদরদী এবং দেশদরদী। একশত বছর পরে কী দরকার সেটা চিন্তা করেছিলেন। চট্টগ্রামের মানুষ যখন ভেটেরিনারি কী বুঝতো না, তখন তিনি এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর দূরদর্শী চিন্তার ফলে এখন দুধ এবং কোরবানির গরুর সংকট নেই। প্রায় ১৫ বছর আগে একবার সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। তখন চট্টগ্রামের মানুষের করুণ দশা। রক্ত পরীক্ষা করার মেশিন নেই। তখন পূর্বকোণ থেকে প্লাটিলেট পরীক্ষার মেশিন ক্রয় করার প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদেরকে নিতে হবে।

ড. সেকান্দর চৌধুরী বলেন, তিনি একজন স্বনির্মিত মানুষ ছিলেন। আমরা তাঁকে পত্রিকার প্রকাশক হিসাবে মূল্যায়ন করতে পারি। কিন্তু এর বাইরে তিনি কিভাবে চিন্তা করলেন একটি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার, চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদ করে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা করা, কর্ণফুলী সেতুসহ নানাবিধ কাজ। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে চট্টগ্রাম এগিয়ে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধেও রয়েছে চট্টগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। আজকাল কত কিছুর জন্যই কত ব্যক্তি আর কত প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। আর যে মানুষটি একটি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য বহুমুখী কর্মপরিচালনাা করেছেন, একটি আধুনিক সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তিনি কখনো বিস্মৃত হবেন না।

ডা. ইমরান বিন ইউনুস বলেন, মরহুম ইউসুফ চৌধুরীকে দুইটি পদক দেয়া যায়। একটি হচ্ছে একুশে পদক, অন্যটি স্বাধীনতা পদক। ইউসুফ চৌধুরীর কথা যদি আমরা চিন্তা করি তিনি একুশে এবং স্বাধীনতা দুটি পদকই পাওয়ার যোগ্য। আমি বৃহত্তর উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটিকে আমি আহ্বান জানাবো ওনার কাজগুলো লিপিবদ্ধ করে সরকারকে জানাতে। এখনো পর্যাপ্ত সময় আছে, পরবর্তী একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক ঘোষণার আগেই আমাদের কাজগুলো শেষ করতে হবে। আমরা সবাই কোন না কোনভাবে ইউসুফ চৌধুরীর কাছে ঋণী। এই কাজের মাধ্যমে উনার ঋণ কিছুটা হলে শোধ করার সুযোগ এসেছে।
সাবেক সাংসদ সাবিহা মুসা বলেন, ইউসুফ চৌধুরী একজন জ্ঞানী ও অধিক গুণের মানুষ। তিনি দেশপ্রেমিক এবং একজন মানবপ্রেমিক মানুষ। তিনি দেশকে যেমন ভালোবেসেছেন, তেমনি ভালোবেসেছেন দেশের প্রত্যেকটি মানুষকেও। বিশেষ করে তিনি চট্টগ্রামের মানুষের জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন। ত্যাগ-ভালোবাসা হচ্ছে একজন সফল মানুষের মূল কাজ। তিনি তাই করেছেন। তিনি ছিলেন একজন ত্যাগী পুরুষ। বর্তমানে দেশে যেভাবে ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি, তিনি থাকলে তাতে নজর দিতেন। কেননা এসব তিনি কখনোই সহ্য করতেন না।
লায়ন নাজমুল হক মিয়া বলেন, ইউসুফ চৌধুরী নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সংগঠন থেকে শুরু করে সকল বিষয়ে কাজ করেছেন। তাঁর সকল কর্ম ছিল মানুষের জন্য ও চট্টগ্রামবাসীর জন্য। তিনি নিজেকে চট্টগ্রামের জন্য উৎসর্গ করে গেছেন। তাঁর হাত ধরে চট্টগ্রামবাসী অনেক কিছু পেয়েছে। তাঁকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত করা হোক।
মাহফুজুল হক শাহ চৌধুরী বলেন, ব্যবসা পরিচালনা করতে গেলে সমাজকর্মী হওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মরহুম ইউসুফ চৌধুরী। আজকে প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় যেসব মেগা প্রকল্প চট্টগ্রামে বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলো তিনি তিরিশ বছর আগেই চিন্তা করেছিলেন।

সভাপতির বক্তব্যে ডা. শেখ শফিউল আজম বলেন, সংগঠনের স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীকে সম্মান জানানো হলে চট্টগ্রামবাসী সম্মানিত হবে। দেশবাসী সম্মানিত হবে। তাঁর জাতীয় স্বীকৃতি আদায়ে যে যার অবস্থান থেকে ভুমিকা রাখতে হবে। এই ভুমিকা হবে সমন্বিতভাবে।

সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি লায়লা ইব্রাহিম বানু, সহসভাপতি আলহাজ মোহাম্মদ উল্লাহ, সহ-সভাপতি সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ শহিদুল আলম, যুগ্ম মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও আলহাজ মোহাম্মদ নুরুল আলম, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ আনোয়ার আজম, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মুছা, মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন প্রমুখ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট