চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

স্মার্টকার্ডেও জালিয়াতি

কর্ণফুলী উপজেলার এক চেয়ারম্যানসহ আটজনকে স্মার্টকার্ড দিয়েছেন শাহানুর

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:২৭ পূর্বাহ্ণ

কর্ণফুলী উপজেলায় এখনো স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্টকার্ড) দেয়নি নির্বাচন কমিশন। ইসি দিতে না পারলেও কী ! জালিয়াতি চক্রের শাহানুর মিয়া তো আছে। জালিয়াতির মাধ্যমে এলাকার আটজনকে স্মার্টকার্ড বানিয়ে দিয়েছেন তিনি। নির্বাচন কার্যালয় সূত্র জানায়, কর্ণফুলী উপজেলা ও বড় উঠান ইউনিয়নের আট ব্যক্তি স্মার্টকার্ড পেয়েছেন। ২০১৭ সালে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাচনের আগে স্মার্টকার্ড নিয়েছেন তারা। এসব কার্ড নির্বাচন কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শন করেছেন। ঢাকা নির্বাচন কমিশনে আইডিইএ প্রকল্পের টেকনিকেল এক্সপার্ট শাহানুর মিয়া এই স্মার্টকার্ড বানিয়ে দিয়েছেন বলে জানান স্মার্টকার্ড পাওয়া একজন। তবে টাকার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। এসব চেয়ারম্যান ম্যানেজ করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

নির্বাচন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্মার্টকার্ড নেওয়ার সময় ১০ আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ নেওয়া হয়। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এসব নেওয়া হয়। কিন্তু কর্ণফুলীতে অবৈধভাবে নেওয়া স্মার্টকার্ড গ্রহণকারীদের

চোখের আইরিশ ও আঙ্গুলের ছাপ কিভাবে নেওয়া হয়েছে।

কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কর্ণফুলী উপজেলায় এখনো স্মার্টকার্ড বিতরণ করা হয়নি। কিন্তু জনপ্রতিনিধিসহ আট ব্যক্তি দুই বছর আগে কীভাবে স্মার্টকার্ড পেয়েছেন তা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।
স্মার্টকার্ড পাওয়া ইউপি চেয়ারম্যানের এক সহযোগী জানান, ‘প্রায় দুই-আড়াই বছর আগে চেয়ারম্যানসহ আমাদের বেশ কয়েকজনকে শাহানুর স্মার্টকার্ড করে দিয়েছিলেন। তবে তিনি কিভাবে করে দিয়েছেন তা আমরা জানি না।’

ইসি সূত্র জানায়, স্মার্টকার্ডে ব্যক্তির নাম (বাংলা ও ইংরেজি), মা-বাবার নাম, জন্ম তারিখ ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন নম্বর দৃশ্যমান। কার্ডের পেছনে ব্যক্তির ভোটার এলাকার ঠিকানা, রক্তের গ্রুপ ও জন্মস্থান। সব মিলিয়ে স্মার্টকার্ডের তথ্যভা-ারে ৩২ ধরনের তথ্য রয়েছে। যা মেশিনে পাঠযোগ্য। স্মার্টকার্ডে তিন স্তরে ২৫টির অধিক নিরাপত্তা থাকবে। এই স্মার্টকার্ড বর্তমান জাতীয় পরিচয়পত্রের চেয়ে অনেক বেশি স্থায়ী ও টেকসই। স্মার্টকার্ডটি সহজে নকল করা যাবে না। এসব কার্ডে চিপ, দুটি বারকোড, মেশিন রিডেবল জোন (এমআরজেড) এ তিনটি স্তর থাকবে।
ঢাকা নির্বাচন কমিশনের টেকনিকেল সাপোর্ট শাহানুর মিয়া শুধু জালিয়াতির মাধ্যমে শুধু রোহিঙ্গাদের ভোটার করেনি। নির্বাচন কমিশনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বমানের এই স্মার্টকার্ডও নকল করেছেন শাহানুর মিয়া। যা নির্বাচন কমিশনের জন্য ভয়ংকর দুঃসংবাদ।

শাহনুর মিয়ার বাড়ি কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মাওলানা মুহিব উল্লাহ খানের বাড়ি। গ্রামে দ্বিতল পাকা বাড়ি নির্মাণাধীন রয়েছে। নিচ তলার কাজ শেষ করে তা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। দোতলার কাজ এখনো শেষ হয়নি। তবে তাদের পরিবার গ্রামের বাড়িতে থাকে না। পোর্ট কলোনি এলাকায় থাকেন। শাহানুর মিয়া চাকরির সুবাধে ঢাকায় বসবাস করেন। শাহনুরের ফুফাতো ভাই শহীদ গ্রামের বাড়িটি দেখাশোনা করেন। তবে শাহানুর ছয় মাস ধরে গ্রামে ঘনঘন আসা-যাওয়া করেছেন বলে এলাকাবাসী জানায়।

জালিয়াতির মাধ্যমে রোহিঙ্গা নাগরিকদের ভোটার ভোটার করার জন্য তিনটি সিন্ডিকেট চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দুদক। এরমধ্যে দুইটি সিন্ডিকেটের প্রধান হোতা এখন পুলিশের কবজায়। শাহানুরের নেতৃত্বে রয়েছে আরেকটি সিন্ডিকেট। শাহানুর চিকিৎসার জন্য ভারতে রয়েছেন বলে জানান জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা।
শাহানুর মিয়ার মিয়া ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের টেকনিকেল সাপোর্ট হিসেবে কর্মরত রয়েছে। সেই সুবাদে ইসি’র কেন্দ্রীয় সার্ভার ছিল তাদের হাতের নাগালে। ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের ভোটার নিবন্ধন করাসহ নানা ধরনের অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

শাহানুর মিয়া রোহিঙ্গাদের ভোটার করার জন্য ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিতেন বলে দুদকে দায়ের করা এক অভিযোগ সূত্র জানায়। এতে তার অঢেল সম্পত্তি রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। নগরীর বন্দর এলাকায় অর্ধ কোটি টাকার দুটি দোকান রয়েছে। গ্রামের বাড়িতেও ৪০ লাখ টাকা দামের জায়গা কিনেছেন। রয়েছে গাড়ি ও নামে-বেনামে ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা। নির্বাচন কমিশনে তার আত্মীয়স্বজন অন্তত ১০ জন চাকরি করছেন। তাদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন শাহানুর মিয়া।

প্রসঙ্গত, গত ১৮ আগস্ট লাকী নামে এক রোহিঙ্গা নারী জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য হাটহাজারী নির্বাচন অফিসে যান। আইডি কার্ড নিয়ে সন্দেহ হলে পরদিন জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আনা হয়। ইসির কেন্দ্রীয় সার্ভারে লাকীর যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ থাকলেও উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্যে লাকী নামে কোন এনআইডি ইস্যু করা হয়নি। এভাবে ভুয়া এনআইডি তৈরির জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ পায়। এই ঘটনার পর তোলপাড় শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুদক ও নির্বাচন কমিশনের একাধিক দল রোহিঙ্গা ভোটার নিয়ে তদন্ত করেছে। ইতিমধ্যেই ডবলমুরিং অফিসের পিয়ন জয়নাল আবেদীন ও অস্থায়ী কর্মচারী টেকনিকেল সাপোর্ট মোস্তফা ফারুককে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট