চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

লুটেপুটে খাওয়ার মহোৎসব

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:৩০ পূর্বাহ্ণ

বান্দরবানের মতো রাঙামাটিতেও সরকারি খাদ্যশস্য নিয়ে চলছে ‘তুঘলকিকা-’। সরকারি গম খোলা বাজারে বিক্রি, চাল নিয়ে নয়-ছয়, পরিবহন ও শ্রম ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে চরম অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তিন কর্মকর্তায় জিম্মি খাদ্য বিভাগ।
সরকার পাহাড়ি বাসিন্দাদের সামাজিক সুরক্ষায় ন্যায্যমূল্যে আটা, চাল বিক্রি করে আসছে। সরকার ভর্তুকি দিয়ে ১৪ টাকা দরে মিল মালিকদের কাছে গম বিক্রি করে। সেই গম থেকে আটা করে পাহাড়ি বাসিন্দাদের কাছে ন্যায্যমূল্যে ১৬ টাকা দরে বিক্রি করে সরকার। অথচ খোলা বাজারে গম বিক্রি হচ্ছে ২৭ টাকা দরে। সরকার থেকে ভর্তুকি দামে ১৪ টাকা দরে কিনে খোলা বাজারে বিক্রি করতে পারলেই লাভ ১৩ টাকা। লাভ দ্বিগুণের কাছাকাছি। অভিযোগ রয়েছে, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মিল মালিকেরা সরকারি গম পাচার করে দেয় খোলা বাজারে।

শুধু গম বা আটা নিয়ে অনিয়ম নয়, পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। একাধিক ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

অভিযোগ রয়েছে, রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক মামুনুর রশিদ, সাবেক কর্মচারী অশোক ধর ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিয়ন্ত্রণ করেন সব অনিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, অফিস সহকারী অশোক ধর সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেও তার দাপট রয়েছে খাদ্য বিভাগে। সকল অনিয়মের হোতা হচ্ছে মামুন ও অশোক। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে বশে এনে অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গম নিয়ে জোচ্চুরি : খাদ্য অধিদপ্তর আটা-ময়দা মিল মালিকদের মাধ্যমে গম মিলিং করে আটা গ্রহণ করে। এতে ৭৭ শতাংশ আটা পাওয়া যায়। বাকি ৩৩ শতাংশ উচ্ছিষ্ট যায়। কিন্তু রাঙামাটিতে গমের চাহিদা অপ্রতুল। এতে বরাদ্দের সিংগভাগ গম খোলা বাজারে পাচার হয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
একাধিক সূত্র জানায়, প্রতি টনে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের গুনতে হয় ৫ হাজার টাকা করে। এছাড়াও উৎপাদন ক্ষমতা বেশি দেখিয়ে নিজেদের পছন্দ মতো মিলকে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে এজন্য আবার চট্টগ্রাম সাইলো অধীক্ষকের জন্য উৎকোচ গুনতে হয়।

একাধিক মিল মালিক জানান, রাঙামাটি প্যারামাউন্ট ফ্লাওয়ার মিল নামে একটি মিলকে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি দেখিয়ে বরাদ্দের সিংহভাগ গম বরাদ্দ দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। অভিযোগ রয়েছে, ওই মিলের মালিকানার মধ্যে একটি শেয়ার রয়েছে সাবেক কর্মচারী অশোক ধরের। তাই অনেকটা অচল একটি মিলের নামে চাহিদার অর্ধেকের বেশি গম বরাদ্দের জন্য প্যারামাউন্ট ফ্লাওয়ার মিলকে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সুপারিশ পাঠিয়েছে রাঙামাটি খাদ্য নিয়ন্ত্রক।
সরকার পাহাড়ি দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খাদ্যে বড় ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খাদ্য বিভাগের অসাধু কর্মকর্তার কারণে সরকারের মহৎ উদ্যোগ অনেকটা ভেস্তে যাচ্ছে। ভর্তুকির লাখ লাখ টাকা লুটেপুটে খাচ্ছে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও মিল মালিকেরা।

পরিবহন ও শ্রম ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম : রাঙামাটি জেলা সদর থেকে নৌ ও সড়ক পথে সরসকারি খাদ্যশস্য জেলার বিভিন্ন সরকারি গুদামে সরবরাহ করা হয়। নৌপথে পরিবহন করা হয় বিলাইছড়ি, বাঘাইছড়ি, লংগদু, দুধছড়ি। সড়কপথে যোগাযোগব্যবস্থা দুর্গম ও দুর্ভেদ্য হওয়ায় নৌপথে পরিবহন করা হয়। এছাড়াও সড়ক পথে কাপ্তাই, বড়ইছড়ি, কাউখালী, লংগদু, বাঘাইছড়ি খাদ্য গুদামে পরিবহন করা হয়। সরকারি খাদ্যশস্য পরিবহনে ঠিকাদারি নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি ঠিকাদার নিয়োগে ৪ লাখ থেকে ৬ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ঠিকাদারদের। যার মধ্যস্থতা করেন মামুন ও অশোক ধর। পরিবহন ঠিকাদার সূত্র জানায়, খাদ্য বিভাগের পরিবহন ঠিকাদারি হচ্ছে দুর্নীতির আখড়া। প্রতিটি খাদ্য গুদামে মালামাল উঠানো-নামানোতে ঠিকাদারদের কাছ থেকে ট্রাকপ্রতি ৮শ থেকে এক হাজার টাকা নেওয়া হয়। তারপরও শ্রম ঠিকাদাররা বড় মাসে বড় অঙ্কের বিল আদায় করে সরকার থেকে। বড় ধরনের দুর্নীতি হয়ে আসছে শ্রম ঠিকাদারে।

রাঙামাটি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুমাইয়া নাছরিনকে একাধিকবার কল দেওয়ার পরও তিনি রিসিভ করেননি। তবে অশোক ধরকে ঠিকাদার পরিচয় দিয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, সবখানে ঝামেলা। স্থানীয় ও চট্টগ্রাম শহরের ঠিকাদারদের মধ্যে সমঝোতা হচ্ছে না। ঠিকাদাররা সমঝোতা না করায় ইচ্ছেমতো দর দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, সবেমাত্র দরপত্র খুলেছি। যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আপনি তো এখন আর চাকরিতে নেই, তারপরও কিভাবে দরপত্রে জড়িত রয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অফিস ডাকলে যাই। প্রতিদিন যাই না। তবে কাজ পাইয়ে দিতে সহায়তার জন্য মামুন ও হিসাব রক্ষক জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট