চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পিতা-পুত্রের ইয়াবা সিন্ডিকেট

ব্যাংকে কাড়ি কাড়ি টাকা লেনদেন

নাজিম মুহাম্মদ

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:০৬ পূর্বাহ্ণ

টেকনাফের রবিউল আলম লেখাপড়া করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগে। ভাই ফরিদুল আলম এলাকায় ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত। বাবা হাজী ছিদ্দিক আহমদ এলাকার মানুষের দৃষ্টিতে সমাজসেবক। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তারা ভাল মানুষ সাজলেও পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে পিতা পুত্র তিনজনেই ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত। ইয়াবা পাচার করতে রীতিমতো তারা সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। ৫০ হাজার পিস ইয়াবা নিয়ে ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ কর্ণফুলী থানার পিএবি সড়কে চাচাতো ভাই জসিম সরকারি স্টিকার লাগানো একটি পাজেরো জীপসহ নগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল। জীপটির মালিক ফরিদুল। পিতা পুত্র তিনজনই কক্সবাজার টেকনাফ ও ঢাকার তেজগাঁও থানায় একাধিক মামলার আসামি।
২০১৮ সালের ১০ জুলাই পিতা-পুত্র তিনজনসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান। প্রতিবেদনে বাদ দেয়া চার আসামির পূর্ণাঙ্গ নাম ঠিকানা বের করতে আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) পুনরায় তদন্তের আদেশ দেন। সম্প্রতি ওই আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন পিবিআই’র পরিদর্শক নূর আহমদ। আসামিরা হলেন, টেকনাফ সদর থানার ছিদ্দিক আহমদ তার দুই ছেলে ফরিদুল আলম, রবিউল আলম, ছিদ্দিকের ভাইয়ের ছেলে জসিম উদ্দিন, তাদের সহযোগী নাজির পাড়ার জকির আহমদের ছেলে আবদুল মালেক, সমসুল ওরফ শফিকুল ইসলাম, আবদুল মালেক ও আনোয়ারা থানার বৈরাগ ইউনিয়নের ছালে জাহাঙ্গীর। জসিম ঘটনাস্থলে ধরা পড়লেও অন্যদের হদিস পায়নি পুলিশ। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছিদ্দিক আহমদ ও তার দুই ছেলে ফরিদ আর রবিউল পেশাদার ইয়াবা ব্যবসায়ী। ঘটনাস্থল ইয়াবা নিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া জসিম রবিউলের চাচাতো ভাই।

ইয়াবা পাচার করতে সরকারি কাজে ব্যবহৃত পুরাতন পাজেরো জীপ কিনে তাকে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড ও সরকারি স্টিকার ব্যবহার করে ফরিদ। তার ছোট ভাই রবিউল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। ইয়াবা পাচার করতে তাদের নিজস্ব সিন্ডিকেট রয়েছে। ফ্ল্যাগ স্টান্ড লাগানো দামী পাজেরো গাড়িতে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের স্টিকার লাগিয়ে তারা মূলত ইয়াবা পাচার করে।
ব্যাংক হিসাবে টাকা আর টাকা : ইয়াবা নিয়ে ধরা পড়া জীপের মালিকের সন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া রবিউল তার বড় ভাই ও বাবা সবাই ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত। জীপটির মালিক ফরিদুল। পরবর্তীতে তদন্ত করতে গিয়ে তাদের ব্যাংক হিসাবে এ কয়বছরে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা লেনদেনের সন্ধান মেলে। তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দায়েরের সুপারিশ জানিয়ে সিআইডির কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।

মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া রবিউলের আল আরাফাহ ব্যাংক টেকনাফ শাখার একটি হিসাব (হিসাব নম্বর-১০২১১২০০২৯৩২৪) খোলেন ২০১৫ সালের ২৮ মে। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত উক্ত হিসাবে লেনদেন হয়েছে ৫৩ লাখ ২৭ হাজার একশো ৮৭ টাকা। একই ব্যাংকে গত ২৭ মার্চ খোলা একটি মুদরাবা হিসাবে (নং-১০২১৩১৩৩৩৫৩৩৯) ৩০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। আয়ের উৎস হিসাবে জমির ব্যবসা দেখানো হলেও তার কোন ট্রেড লাইসেন্স বা টিআইএন নম্বর নেই। একইভাবে তার ভাই ফরিদুল আলমের নামে ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখায় দুটি, আল আরাফাহ ব্যাংক টেকনাফ শাখায় তিনটি আলাদা আলাদা হিসাবে এক কোটি ৯০ লাখ তিন হাজার ৯১ টাকার লেনদেন হয়েছে। অধিকাংশ টাকা রাজধানীর নবাবপুর, রমনা, ইসলামপুর, গাজিপুর চৌরাস্তা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকা থেকে পাঠানো হয়েছে। ফরিদুলের বাবা সিদ্দিক আহমদের নামে আল আরাফাহ ও জনতা ব্যাংক টেকনাফ শাখার চারটি হিসাবে তিন কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার নয়শো ৪৭ টাকার লেনদেন হয়েছে। শুধু তাই নয়। ফরিদুলের স্ত্রী রায়হানা আক্তারের নামে আল আরাফাহ ও জনতা ব্যাংক টেকনাফ শাখায় দুটি হিসাবে ১৮ লাখ ১৮ হাজার চারশো ৮৪ টাকার লেনদেন হয়েছে। ফরিদুলের আরেক ভাই রাশেদুলের নামেও জনতা ব্যাংক টেকনাফ শাখায় একটি স্কুল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর রয়েছে। যাতে দুই লাখ ১০ হাজার একশো ৫৫ টাকার লেনদেনের তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবমিলিয়ে রবিউল, ফরিদুল, স্ত্রী রায়হানা, ভাই রাশেদুল ও বাবা সিদ্দিক আহমদের হিসাবে এ কয় বছরে ছয় কোটি ৪০ লাখ ৩৭ হাজার টাকার লেনদেন হয়েছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট