চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ম্লান শত কোটি টাকার সৌন্দর্য

আল-আমিন সিকদার

১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:৫৩ পূর্বাহ্ণ

অযত্ন আর অবহেলার কারণে গত তিন বছর আগেও দর্শনার্থী শূন্য হয়ে পড়েছিল পতেঙ্গা সৈকত। দর্শনার্থী হারাতে বসা এ সমুদ্র সৈকতকে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে শত কোটি টাকা ব্যয়ে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সমুদ্রের ঢেউয়ের আদলে তিন স্তরে করা হয়েছে সৈকত পাড়ের ডিজাইন। তৈরি করা হয়েছে ওয়াকওয়ে, লিংক রোড ও কিডস জোন। যেখানে সৌন্দর্যবর্ধনে বসানো হয়েছে ফুলগাছ ও বিশ্রাম চেয়ার। সব মিলিয়ে নবরূপে সেজেছে পতেঙ্গা সৈকত। যে রূপে আকৃষ্ট হয়ে সেই দর্শনার্থী শূন্য পতেঙ্গা সৈকত আবারো মুখরিত হয়ে ওঠে পর্যটকদের পদচারণায়। তবে আবারো অযত্ন আর অবহেলায় পর্যটক হারানোর পথে এ সৈকত।
‘সবার কপালে নাকি সুখ সয় না’ প্রচলিত এ প্রবাদটির মতই যেন চট্টগ্রামবাসীর ভাগ্য। সৌন্দর্য উপভোগের আগেই তা ম্লান হতে বসেছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সৈকত পাড়ে শত কোটি টাকা ব্যয়ে যে নির্মাণ কাজ চলছে তা শেষ হতে না হতেই ‘কিডস জোন’ দখলে নিয়ে নিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ হকাররা। দু’পাশ ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত ভ্রাম্যমাণ দোকান। যা এখন ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দর্শনার্থীদের কাছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণ কাজ চলমান অবস্থায় শিশুদের জন্য নির্মাণাধীন ‘কিডস জোন’ এর জায়গা দখলে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসিয়েছে হকাররা। এখানে খাবার থেকে শুরু করে জামা-কাপড় ও রকামারি পণ্যের দোকান। এছাড়া সৈকত পাড়ের সৌন্দর্য রক্ষায় ‘ময়লা ফেললে হাজার টাকা জরিমানা’ উল্লেখ করে সাইনবোর্ড বসিয়েছে সিডিএ। তবে এই সাইন বোর্ডের পাশেই কিছু ভ্রাম্যমাণ খাবার দোকানিকে দেখা যায় খাবার বিক্রি করতে। এছাড়া পর্যটকদের খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশগুলো সমুদ্রে ফেলতে দেখা যায় এসব দোকানদারদের। ফলে নবরূপে রঙিন এই পতেঙ্গা সৈকত দেখতে আসা পর্যটকরা উপভোগ করতে পারছেনা প্রকৃত সৌন্দর্য।

রবিকু- নামে এক পর্যটক প্রতিবেদককে বলেন, ‘বহু বছর আগে মিরসরাই থেকে পুরো পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছিলাম এই সৈকতে। তখন সাগর পাড়ের পরিবেশটা আত্মীয়-স্বজন নিয়ে আসার মত ছিলো না। কিন্তু গত কয়েক মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের নতুন রূপের ছবিগুলো দেখে ইচ্ছে জাগে আবার এখানে আসার। আজ সকালে আমার বউ বাচ্চা ও পুরো পরিবার নিয়ে একটি হায়েস ভাড়া করে চলে এলাম পতেঙ্গা দর্শনে। তবে এখানে এসে গাড়ি থেকে নেমেই দেখি সমুদ্র পাড়জুড়ে শুধু দোকান আর দোকান। এতো দোকান যে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে না। দেখে মনে হয়েছে এ যেন আরেকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। তবে কিছুটা জায়গা রয়েছে হকারমুক্ত যেখানে এসে মন ভরে সমুদ্র দেখলাম’। পাশাপাশি ট্যুরিস্ট পুলিশের দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘পর্যটক এরিয়াতে ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ থাকে। কিন্তু সারাদিন বেড়ানোর পরেও পুরো বিচে একজন ট্যুরিস্ট পুলিশ দেখিনি। যারা এখানে কর্মরত আছেন তারা কী কাজ করছেন’। এমন চলতে থাকলে আবারো পতেঙ্গা সৈকত পর্যটক শূন্য হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, সৌন্দর্য রক্ষায় রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের ইশারায় আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে ভ্রাম্যমাণ হকারগুলো। প্রতিটি দোকান থেকে ৫০ টাকা করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। শুধু সিকিউরিটি গার্ডরা নয়, হকারদের দখল করা ভ্রাম্যমাণ মার্কেটটি থেকেও প্রতিনিয়ত চাঁদা আদায় করে আসছে একটি চক্র। দুই শতাধিক দোকান থেকে প্রতিদিন ১৫ হাজারেরও বেশি টাকা চাঁদা তুলছে তারা।

কিডস জোনে রমজানের চটপটির দোকানে বসা রাজীব নামে এক যুবকের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘জাহাঙ্গীর চৌধুরী নামে একজন প্রতি দোকান থেকে ৬০ টাকা করে নেন’। টাকাগুলো কার নেতৃত্বে নেয়া হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওয়াহিদ মাস্টার নামে একজন এগুলোর দেখভাল করেন। তবে তার বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ নেই। কারণ, তাকে টাকা দেয়ার বিনিময়ে আমরা ব্যবসা করে পরিবার চালাতে পারছি’। এখানে কি পরিমাণ দোকান আছে জানতে চাইলে রাজীব নামে ওই যুবক বলেন, ‘খাবারের দোকান, বার্মিজের দোকান ও ঝিনুকের দোকান মিলিয়ে প্রায় দুইশ’র বেশি দোকান হবে’।
এদিকে প্রতিটি দোকান থেকে টাকা আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করেন ওয়াহিদ মাস্টার। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, দোকানগুলো দেখভাল করার জন্য যে সিকিউরিটি গার্ড রাখা হয়েছে তাদের বেতন দেয়ার জন্য এসব টাকা নেয়া হয়। এছাড়া এখানে দোকান বসানোর জন্য এমপি মহোদয় ও পুলিশ কমিশনারের অনুমতি নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম. এ. লতিফ পূর্বকোণকে বলেন, ‘অনুমতি দেয়ার আমি কেউ না। তবে তাদের দোকান বসানোর বিষয়ে আমি জানি। কিন্তু দোকান বসিয়ে সেখান থেকে চাঁদা আদায় করার বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমি যত দ্রুত সম্ভব দোকানগুলো পরিদর্শনে যাবো। এছাড়া যেহেতু জায়গাটি নির্মাণাধীন তাই তাদের বসার বিষয়টি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কারণ, তারা যেখানে নির্মাণ কাজ চলছে না সেখানে বসেছে। কাজে ব্যাঘাত হলে তারা সরে যাবে’।

এসব হকারদের উচ্ছেদে দ্রুত অভিযান শুরু করা হবে বলে জানান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘কয়েক মাস আগেও এসব হকাররা ওয়াকওয়ে দখল করে দোকান বসিয়েছিলো। আমরা উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমে তাদের সরিয়ে দিয়েছে। এখন আবারো দখল হয়েছে। তাই দখলমুক্ত করতে খুব দ্রুত আমরা এখানে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করব। এখানে দোকান বসাতে দেওয়া হবে না’।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট