চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সাড়ে ৩ বছরে মৃত্যু ৬৬ চলতি বছরেই ১৬

জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:০৩ পূর্বাহ্ণ

ষ আহত ও নিহতের সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি
ষ নেওয়া হয়নি কোন আইন ব্যবস্থা
ষ মানা হচ্ছে না শ্রমিক নিয়োগ বিধিমালা
ষ নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টিসহ ১০ দফা দাবি

সীতাকু-ে অবস্থিত শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় গত সাড়ে তিন বছরে মৃত্যু হয়েছে ৬৬ জন শ্রমিকের। এরমধ্যে শুধুমাত্র চলতি বছরেই মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। এই ১৬ জনের মধ্যে গ্যাস বিস্ফোরিত হয়ে মৃত্যু হয় নয় জনের আর প্লেট চাপা পড়ে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। নিহত ছাড়াও গত আট মাসে গুরুতর আহত হয়েছে ৩০ জনেরও বেশি শ্রমিক। সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট বারআউলিয়ায় অবস্থিত জিরি সুবেদার নামক শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কর্মরত অবস্থায় লোহার তার ছিড়ে দুই জন শ্রমিক নিহত হয়। এতে আহত হয় আরও ১০/১২ জন শ্রমিক। এর এক মাস আগে ৩১ জুলাইয়ে সোনাইছড়িতে অবস্থিত ম্যাক কর্পোরেশনে জাহাজ কাটার সময় বিষাক্ত গ্যাস বিষ্ফোরিত হয়ে তিন জন শ্রমিক নিহত হয়। এতে আহত হয় চার জন। তবে এসব দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা মারা গেলেও শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের মালিকরা আহত ও নিহতদের সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি করে থাকেন বলে দাবি করেন জাহাজ-ভাঙ্গা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম নেতৃবৃন্দ। দিনদিন জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিকের মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেলেও দায়ী মালিকদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না উল্লেখ করে প্রাণহানি মোকাবিলায় কারখানাগুলোতে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ সৃষ্টিসহ ১০ দফা দাবি জানিয়েছেন সংগঠনটি। গতকাল বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম

প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন তাঁরা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক শফর আলী বলেন, আগামী সাতদিনের মধ্যে দাবি মেনে না নিলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

তিনি বলেন, সীতাকু-ে অবস্থিত জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কর্মরত শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিন-ই কোন কোন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে এসব শ্রমিকরা। জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প সেক্টর বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর অধীনে পরিচালিত হলেও বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী কোন সুবিধা পাচ্ছেনা শ্রমিকরা। আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের নিয়োগ পত্র দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হচ্ছে না। ২০১৮ সালে ঘোষিত মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ অনুযায়ী এই শ্রমিকদের মাসিক মজুরি নূন্যতম ১৬ হাজার টাকা এবং দৈনিক ৬১৫ টাকা ধার্য্য করে বাধ্যতামূলক করা হলেও তা মানছেন না মালিকরা।

শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মস্থলে নিহত শ্রমিকদের দুই লাখ টাকা এবং জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত ক্রাইসিস কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক আরও পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও তা সকল নিহত শ্রমিকের পরিবার ঠিক মতো পাচ্ছে না উল্লেখ করে সফর আলী আরও বলেন, অস্থায়ী ভিত্তিতে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে বিধায় দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা আহত বা নিহত হলে ইয়ার্ড মালিকরা এর দায় নেয় না। জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যার কারণে ইয়ার্ডের মালিকরা সরাসরি কোন শ্রমিক নিয়োগ না করে ঠিকাদারের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এসব ঠিকাদার জাহাজ কাটা ছাড়া শ্রমিকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোন ধারনাই নেই। তাই ঝুঁকি নিরসনে কোন ব্যবস্থা তারা নেয়না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, এসব কাজ করার সময় শ্রমিকদের নূন্যতমভাবে আত্মরক্ষারমূলক সরাঞ্জামাদী সরবরাহ করার কথা থাকলেও তাও দেওয়া হয়না। ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়েই শ্রমিকরা বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছেন। চলতি বছরে শ্রমিকদের মৃত্যু অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙেছে। একজন শ্রমিকের মৃত্যুর দায়ও ইয়ার্ডের মলিকরা এড়াতে পারেন না। অথচ মালিকদের বিরুদ্ধে কখনোই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বছরের পর বছর শ্রমিকরা মৃত্যুর শিকার হলেও তাদের বিরুদ্ধে জারি হয়নি হুলিয়াও। এর জন্য রাষ্ট্রও কোনভাবে দায় এড়াতে পারে না। তাই কারখানাগুলোতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি এবং আহত নিহতদের পরিবারের ক্ষতি পূরণসহ আধুনিক, নিরাপদ ও সচল যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির আহ্বায়ক তপন দত্ত, যুগ্ম আহ্বায়ক এ এম নাজিম উদ্দিন, অর্থ সম্পাদক রিজওয়ান রহমান খান, সদস্য মোহাম্মদ আলী প্রমুখ।

১০ দফা দাবি হল :
চলতি বছরে সংঘটিত সকল দুর্ঘটনার তদন্তপূর্বক দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন, নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেক পরিবারকে ১০ লাখ এবং আহতদের ১৫ লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ প্রদান। স্ব স্ব ইয়ার্ড মালিকের উদ্যোগে কর্মরত সকল শ্রমিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদান। বিএসবিআর’র ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের ডাটাবেজ সংরক্ষণ। আধুনিক, নিরাপদ ও সচল যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করন। জাহাজ কাটার পূর্বে জাহাজকে পূর্ণাঙ্গভাবে বর্জ্যমুক্ত করণ, প্রচলিত শ্রম আইন-বিধিমালা ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন সমূহ অনুসরণ করে ইয়ার্ড পরিচালনা করা। শ্রমিকদের সংবিধান, শ্রম আইন ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক কনভেনশন দ্বারা স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিতকরণ। শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি মাসিক ১৬ হাজার ও দৈনিক ৬১৫ টাকা কার্যকর এবং ইয়ার্ডকে নিরপাদ ও ঝুঁকিমুক্ত করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট