চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দুর্নীতির রাহুগ্রাসে শাহ আমানত বিমানবন্দর

নিজস্ব প্রতিবেদক

৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ৬:৪৫ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে পদে পদে অনিয়ম যেন ‘স্থায়ী সংস্কৃতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুল্ক ছাড়াই পণ্য খালাস নেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। পণ্য ডেলিভারির সময় কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। আবার এয়ারফ্রেইট ইউনিটে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদন ছাড়াই খোলা হয় রেজিস্টার। অনেক ক্ষেত্রে রেজিস্টার সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা হয় না। সর্বোপরি কাস্টমস কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে একদিকে সরকার প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে ঝুঁকির মুখে পড়ছে জাতীয় নিরাপত্তা।

সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। ৩০ জুলাই প্রতিবেদনটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে দেয়া হয়েছে।

পুরো প্রতিবেদনে কাস্টমস কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা, ঘুষের বিনিময়ে পণ্য খালাস, একজনের পাসপোর্টে আরেকজনের পণ্য খালাস নেয়া এবং সামগ্রিক দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে এপ্রিলে ওই গোয়েন্দা সংস্থা থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের অনিয়ম সম্পর্কিত আরেকটি প্রতিবেদন এনবিআরে পাঠানো হয়েছে।

এনবিআরের কাছে পাঠানো সর্বশেষ (৩০ জুলাই) গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে ২০১৮ সালে ১৩টি ও ২০১৯ সালে ৩টিসহ ১৬টি চালানে সরকারি রাজস্ব দেয়া ছাড়া অনৈতিকভাবে পণ্য খালাস কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এসব চালান খালাস করে ওয়াটারওয়েজ শিপিং এজেন্সিজ নামের চট্টগ্রামের এক সিএন্ডএফ এজেন্ট। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে সিএন্ডএফ এজেন্টরা নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এ ছাড়া বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা এবং সিভিল এভিয়েশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর জালিয়াতির কারণে বর্তমানে কার্গো হাউসে জরাজীর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে।

কাস্টমস কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কার্গো হাউস থেকে পণ্য ডেলিভারির সময় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার বিধান থাকলেও সেটি হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তা সঠিকভাবে দায়িত্ব বণ্টন করেন না। এয়ারফ্রেইট ইউনিটে পণ্য চালান ও ডেলিভারি কার্যক্রম পরিচালনায় স্ক্যানিং মেশিন এবং অনুমোদিত ফরম ও রেজিস্টার ব্যবহৃত হয়।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদন, অফিস আদেশ ও স্বাক্ষর ছাড়াই রেজিস্টার পাওয়া গেছে। এছাড়া রেজিস্টার ও ফরম সঠিক তত্ত্বাবধান ও সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা হয় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, কার্গো শাখায় জালিয়াতির ঘটনায় এক সিএন্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করা হয়েছে। কাস্টমসের অভ্যন্তরীণ তদন্তে নাম উঠে আসা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। নোটিশের জবাবের ভিত্তিতে অধিকতর তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া পুলিশও এ ঘটনা তদন্ত করছে। যদি কাস্টমস কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তাহলে পুলিশও প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেবে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দুই রাজস্ব কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কার্গো শাখা থেকে মালামাল খালাসে সিএন্ডএফ এজেন্টরা দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম কাস্টমসে কর্মরত রাজস্ব কর্মকর্তা রেহেনা পারভীন এবং শুল্ক গোয়েন্দার রাজস্ব কর্মকর্তা মুসার সহায়তায় বিভিন্ন ব্যক্তির পাসপোর্টের বিপরীতে আইনবহির্ভূতভাবে মালামাল খালাস করে আসছে।

জানা গেছে, কার্গো শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য খালাসের ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম কাস্টমস অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করে। অতিরিক্ত কমিশনার-২ কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনকে আহ্বায়ক, সহকারী কমিশনার আমিনুল ইসলামকে সদস্য সচিব এবং সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা প্রসাদ কুমার মণ্ডলকে কমিটির সদস্য করা হয়।

ওই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বন্দর থানায় বাদী হয়ে ফৌজদারি আইনে ওয়াটারওয়েজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামছুদ্দিন এবং কাস্টম সরকার (সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধি) ফারুককে আসামি করে মামলা করেন।

এ ছাড়া ওই ঘটনায় দায়িত্বহীনতা, অদক্ষতা ও অসতর্কতার কারণে রাজস্ব কর্মকর্তা মশিউর রহমান, ফজলুর রহমান, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ইমরান হোসেন, নুরুল মোস্তফা, করুণাময় চাকমা এবং রেডিও অপারেটর স্বপন মজুমদারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া এপ্রিলে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিএন্ডএফ এজেন্টদের সিন্ডিকেট অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে কার্গো ফ্লাইট থেকে মালামাল খালাস নিচ্ছে। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই এয়ারওয়ে বিলপ্রতি ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে চোখ বুঝে মালামাল ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।

৭ ফেব্রুয়ারি দুটি এয়ারওয়ে বিলের অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিএন্ডএফ এজেন্টরা মাল খালাসে যাত্রীদের পাসপোর্ট ও আগমন/বহির্গমনের যে তথ্য দিচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভুয়া। ওই নামের বা নম্বরের কোনো পাসপোর্ট নেই। পাসপোর্টের সব তথ্যই ভুয়া। কাস্টমস কর্মকর্তারাও সিএন্ডএফ এজেন্টদের জমা দেয়া ফরমের সঠিকতা যাচাই করেন না। কার্টনে কী কী বাণিজ্যিক পণ্য আছে, তা-ও পরীক্ষা করে দেখেন না। ফলে যে কোনো সময় ভুল তথ্য দিয়ে মাদকদ্রব্য ও বিস্ফোরক দ্রব্য আনা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে।

সূত্র : যুগান্তর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট