চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

এ কি হাল আবহাওয়া অফিসের!

আল-আমিন সিকদার

৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:২১ পূর্বাহ্ণ

যুগ যুগ ধরে মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি দিয়েই চলছে দেশের সবচেয়ে বড় উপকূলীয় অঞ্চল চট্টগ্রামের আবহাওয়া অফিস। রাডারের অভাবে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসের জন্যও আবহাওয়া অফিসকে তাকিয়ে থাকতে হয় ভারতের দিকে। তাৎক্ষণিক আবহাওয়ার চিত্রের জন্য চোখ রাখতে হয় জাপান ও ভারতের স্যাটেলাইটে। শুধু তাই নয়, আঘাতহানা ভূমিকম্পের মাত্রা জানতে ঢাকা অফিসের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে হয় চট্টগ্রামের আবহাওয়া অফিসকে। এমনকি বিমান চলাচলের জন্য উর্ধ্ব আকাশের বায়ুম-লের অবস্থার ম্যাপটিও ফ্রি সাইট থেকে নামিয়ে বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে দেয় আবহাওয়া অফিস। এতো ‘নেই’ এর মাঝে চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসে যে যন্ত্রটি রয়েছে সেটি হলো, অটোমেটিক ওয়েদার স্টেশন সিস্টেম। দুর্ভাগ্য সেটিও এখন অকেজো।

দুর্গতির এখানেই শেষ নয়, প্রতি তিন ঘণ্টা অন্তর জাতীয় পূর্বাভাস কেন্দ্রে আবহাওয়ার যে উপাত্ত পাঠানো হয়, সে ব্যাপারেও চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের ভরসা মান্ধাতার আমলের ফ্যাক্স। চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের অবস্থা দাঁড়িয়েছে বহু প্রচলিত সেই প্রবাদের মতো- ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার।
বাংলাদেশের কয়েকটি দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চলের একটি চট্টগ্রাম। কিন্তু সমুদ্র তীরবর্তী এ অঞ্চলটিতে যে আবহাওয়া অফিস রয়েছে সেখানে নেই কোন রাডার ব্যবস্থা। বাংলাদেশের ঢাকা, খেপুপাড়া, কক্সবাজার, রংপুর ও মৌলভীবাজারে সর্বমোট ৫টি রাডার রয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের। তাই সমুদ্রে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রামের কতটুকু দূরত্বে রয়েছে তা জানতে পতেঙ্গা পূর্বাভাস কেন্দ্রকে তাকিয়ে থাকতে হয় ভারতের আগরতলা আবহাওয়া অফিসের দিকে। এমনকি ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান ও তাৎক্ষণিক আবহাওয়া জানতে জাপান ও ভারতের স্যাটেলাইটে চোখ রাখতে হয় বলে জানায় পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। অন্যদিকে ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দূর্যোগ আঘাত হানলেও তার মাত্রা নির্ণয় করতে পারে না নগরীর আমবাগানে থাকা আবহাওয়া অফিসের ভূমিকম্প বিষয়ক কার্যালয়।

বিমান উঠা-নামা এবং চলাচলের রুট নির্ধারণ করে আবহাওয়া বার্তা আর এ জন্য প্রতিটি বিমান বন্দরের অভ্যন্তরে থাকে একটি করে আবহাওয়া অফিস। তাই চট্টগ্রাম শাহ্ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরেই পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। বিমান উঠা-নামার জন্য বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট দেয়ার পাশাপাশি স্থানীয় আবহাওয়ারও উপাত্ত নেয় পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। কিন্তু পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস এই গুরুদায়িত্ব পালন করছে মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। শুধু তাই নয়, প্রযুক্তির অভাবে আর্ন্তজাতিক ফ্রি সাইট থেকে ম্যাপ নিয়ে বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে দিচ্ছে তারা।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসে গিয়ে দেখা যায়- বাতাসের চাপ, বায়ুর তাপ, বাতাসের দিক , বাতাসের গতি, বৃষ্টি পরিমাপসহ সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ম তাপমাত্রা নির্ণয় করতে যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে একই প্রযুক্তি। বাতাসের চাপ নির্ণয় করার জন্য ব্যবহার হচ্ছে মান্ধাতার আমলের ব্যারোমিটার ও রেকর্ডের জন্য ব্যারোগ্রাফ। একইভাবে বায়ুর তাপ নির্ণয়ের জন্য থার্মোমিটার ও থার্মোগ্রাফ, বাতাসের গতি নির্ণয়ের জন্য এনোমো মিটার ও এনোমো গ্রাফ, বাতাসের দিক, বৃষ্টি পরিমাপসহ সর্বোচ্চ ও সর্বনি¤œ তাপ মাপার জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে তা সবই মান্ধাতার আমলের। এমনকি প্রতি তিন ঘণ্টা অন্তর অন্তর জাতীয় পূর্বাভাস কেন্দ্রে আবহাওয়ার যে উপাত্ত পাঠানো হয় তাও আদান প্রদান হয় এনালক সিস্টেম ফ্যাক্সের মাধ্যমে। এছাড়া বিমান উড্ডয়নের সময় বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে বায়ুর প্রেসার ও উর্ধ্ব আকাশের যে ম্যাপ সরবারহ করা হয়। তা আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অথরিটি (আইকা) ও ফ্রি সাইট থেকে নেয়া।

আধুনিক প্রযুক্তির ঘাটতি থাকার কথা স্বীকার করে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসে কর্মরত আবহাওয়াবিদ এস. কে ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস পেতে আমরা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি তার সবগুলোই পুরনো। যুগ যুগ ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে যন্ত্রগুলো। উন্নত বিশ্বের আবহাওয়া অফিসগুলো যখন ব্যবহার করছে আধুনিক প্রযুক্তি তখন আমাদের ভরসা সেই এনালগ সিস্টেম। কেউ যদি আমাদের ফোন দিয়ে জানতে চায়- যে আজ কত মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে, তখন দৌড়ে গিয়ে বৃষ্টি পরিমাপ যন্ত্রে স্কেল ঢুকিয়ে তার গাণিতিক হিসাব করে বের করতে হয় বৃষ্টিপাতের পরিমাপ। যদি আধুনিক যন্ত্র থাকতো তাহলে কম্পিউটার মনিটরে তাকিয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বলে দিতে পারতাম। শুধু বৃষ্টিপাত নয়- বাতাসের চাপ, বায়ুর তাপ, বাতাসের দিক, বাতাসের গতিসহ সর্বোচ্চ ও সর্বনি¤œ তাপমাত্রা নির্ণয় করতেও আমরা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছি একই যন্ত্র। এ যন্ত্রগুলো আরো আধুনিক হলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নির্ণয় আরো দ্রুত ও সঠিক হতো।’

বিমানবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনা করতে কতটুকু সক্ষম এ আবহাওয়া অফিস, জানতে চাইলে তিনি বলেন- ‘বিমান উঠা-নামা করতে মাটিতে ও উর্ধ্ব আকাশে বায়ুর চাপ সম্পর্কে জানতে হয় পাইলটকে। বায়ুর চাপ ও গতির ওপর নির্ভর করে যাতায়াত রুট। এজন্য বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিয়ত আবহাওয়া রিপোর্ট দিতে হয় আমাদের। তবে আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে আবহাওয়ার সঠিক উপাত্ত প্রেরণে ব্যর্থ আমরা। তাই উর্ধ্ব আকাশে বায়ুর চাপ ও রুটম্যাপ জানতে বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে ভরসা করতে হয় আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অথরিটি (আইকা) ও বিভিন্ন ফ্রি সাইটের ওপর।’
ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের বিষয়ে জানতে চাইলে এ আবহাওয়াবিদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ দুর্যোগপূর্ণ একটি দেশ। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান ও গতিবিধি জানতে আমাদের সাহায্য নিতে হয় ভারতের আগরতলা আবহাওয়া অফিসের। তাদের রাডার থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর নির্ভর করি আমরা। শুধু তাই নয়, তাৎক্ষণিক আবহাওয়া জানতেও আমাদের নজর রাখতে হয় জাপান ও ভারতের স্যাটেলাইট চিত্রে। তবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কার্যক্রম শুরু হলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নির্ণয় অনেক সহজ ও দ্রুত হবে বলে জানান তিনি। এছাড়া ভূমিকম্পের মাত্রা জানতে চট্টগ্রামের আমবাগানের ঝাউতলায় যে অফিস আছে তাদেরও ঢাকা অফিসের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।’
ভূমিকম্প ও উর্ধ্ব আকাশের বায়ুম-লে আবহাওয়ার উপাদান সংগ্রহ করার কাজ করে আমবাগানের ঝাউতলায় অবস্থিত আবহাওয়া অফিসটি। সরেজমিনে দেখা যায়, জরাজীর্ণ দুইতলা একটি ভবনে চলছে কার্যক্রম। ভবনটির চারপাশ থেকে খসে পড়ছে পলেস্তরা। এরই মাঝে প্রতিদিন গ্যাসভর্তি বেলুন উড়িয়ে উর্ধ্বআকাশের বায়ুম-লে আবহাওয়ার উপাদান সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছেন দায়িত্বরত লোকজন। তবে ভূমিকম্প হলে তাৎক্ষণিক এর মাত্রা জানতে পারেন না তারা নিজেরাও। কারণ, অফিসে ভূমিকম্প মাপার রিক্টার স্কেলের সেন্সর থাকলেও রিসিভার স্থাপন করা হয়েছে ঢাকায়।
আমবাগান আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রামে আঘাত হানা ভূমিকম্পের মাত্রা জানতে আমাদের ঢাকায় যোগাযোগ করতে হয়। কেননা, আমাদের এই অফিসে ভূমিকম্প মাপার সেন্সর থাকলেও রিসিভার ঢাকায়।’ জরাজীর্ণ ভবন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। চারপাশ থেকে খসে পড়ছে পলেস্তরা। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে আমাদের। তবে ভবনটি মেরামতের জন্য গণপূর্ত দপ্তর কাজ করার কথা থাকলেও কোনো এক কারণে আর কাজ শুরু হয়নি।’ এ সময় জনবল সংকটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘পুরো অফিসে যত পদ আছে তত কর্মী নেই। এইখানে আমিই ঝাড়–দার, আমিই কর্মকর্তা। বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়োগ না হওয়ায় এখানে যে কয়েকজন কর্মকর্তা কাজ করেন তাদের সবাইকেই আমার মতো ঝাড়– দিতে হয় বলে জানান তিনি।’

মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, ‘বাতাসের চাপ, বায়ুর তাপ, বাতাসের দিক, বাতাসের গতি, বৃষ্টি পরিমাপসহ সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ম তাপমাত্রা নির্ণয় করতে আমরা যে যন্ত্রগুলো ব্যবহার করি সেগুলো পুরনো হলেও কার্যকরি এবং নিখুঁত তথ্য দেয়। তবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে আবহাওয়া উপাত্তগুলো তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যেত। ধীরে ধীরে সব আধুনিক হবে।’ এ সময় জনবল সংকটের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের আবহাওয়া অফিসগুলোতে সব মিলিয়ে দেড়শতাধিক পদ থাকলেও কর্মী আছে ৬০ জন। নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় এ জনবল সংকটের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি।’ জরাজীর্ণ আবহাওয়া অফিসের সম্পর্কে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘শুধু আবহাওয়া অফিস না কোয়ার্টারগুলোরও একই অবস্থা। গণপূর্তরও কাজ করার কথাও ছিল। তবে কোন এক কারণে কাজ শুরু করেনি তারা।’ সব শেষে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কার্যক্রমকে আরো উন্নত করতে জাতীয় বাজেটে এ খাতে অর্থ বরাদ্ধ বাড়ানোর অনুরোধও করেন তিনি।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট