চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

হালিশহরে অধিগ্রহণকৃত ভূমি নিয়ে জটিলতা

বাধার মুখে সুয়ারেজ প্রকল্প

নয়াবাজারে ১৬৩ একর ভূমিতে কাজ করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা

মোহাম্মদ আলী

৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম ওয়াসা সুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। নগরীর হালিশহর নয়াবাজার এলাকায় অধিগ্রহণকৃত ১৬৩ একর ভূমিতে কাজ করতে গেলে স্থানীয় কিছু লোক বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হালিশহরে ১৯৬৩ সালে তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ১৬৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। কিন্তু ৫৭ বছরেও ওয়াসা সুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারায় বেশ কিছু জায়গা বেদখল করে স্থানীয় কিছু লোক। এমনকি তারা সেখানে বেশকিছু অস্থায়ী স্থাপনাও তৈরি করে ফেলেছে। ওয়াসার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে দখলমুক্ত করেন। এসব জায়গা পাহারা দিতে সেখানে আনসার ক্যাম্পও বসায় ওয়াসা। এর আগে ২০০১ সালে স্থানীয় লোকজনের পক্ষে ছৈয়দ মুহাম্মদ এনামুল হক মুনিরী বাদি হয়ে অধিগ্রহণকৃত ভূমি দীর্ঘদিন ব্যবহার না করে ফেলে রাখার কারণে তা পুনরায় ফেরত পেতে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘদিন এ ভূমি ব্যবহার না হওয়ায় ভূমি মন্ত্রণালয়কে ভূমি পুনরায় অধিগ্রহণ করে তা অন্য কোন রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ব্যবহারে নির্দেশনা প্রদান করে হাইকোর্ট। একই সাথে তিন মাসের মধ্যে এ বিষয়ে আবেদনকারীদের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে নির্দেশ প্রদান করে। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম ওয়াসা সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করলে সুপ্রিমকোর্ট ভূমি অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত না করে ক্ষতিগ্রস্তদের আবেদন বিবেচনার জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে নির্দেশ প্রদান করে। এ অবস্থায় ২০১৭ সালের ৯ মে তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ম্যানুয়েল, ১৯৯৭ এর অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নির্দেশাবলীর ৭৭ ও ৭৮ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট নির্দেশনা অনুযায়ী অধিগ্রহণকৃত অব্যবহৃত ভূমি পূর্বতন মালিকের অনুকূলে অবমুক্তির সুযোগ নেই। এ কারণে আবেদনকারীর আবেদন না মঞ্জুর করা হলো। এ নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে ছৈয়দ মুহাম্মদ এনামুল হক মুনিরী ভূমি ফেরত পেতে একটি আবেদন করেন। ভূমি মন্ত্রণালয় এই আবেদনের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে এ ব্যাপারে মতামত প্রদানের জন্য চিঠি প্রেরণ করে। জেলা প্রশাসনে মতামতের বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে অতি সম্প্রতি বিশাল এই জায়গায় বাউন্ডারি ওয়াল তৈরি করতে গেলে বাধার মুখে পড়ে ওয়াসা। এ ব্যাপারে অনেকটা নড়েচড়ে বসে ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে ওয়াসার সুয়ারেজ প্রকল্প পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘১৯৬৩ সালে হালিশহর আনন্দ বাজার এলাকার ১৬৩ একর জায়গা ওয়াসার সুয়ারেজ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসন সেই জায়গা অধিগ্রহণ করে এর দখল ওয়াসাকে বুঝিয়ে দেন ১৯৬৭ সালের ২৫ মে। সেই থেকে এই জায়গার মালিক চট্টগ্রাম ওয়াসা।’

প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ওয়াসার সুয়ারেজ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এটি বাস্তবায়ন বিলম্বিত হলে ওয়াসার সুপেয় পানির প্রধান উৎস কর্ণফুলী ও হালদা নদী দ্রুত দূষিত হয়ে পড়বে। নগরীর বর্জ্য পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে এ দুটি নদী। তাতে সুপেয় পানির সংকটে পড়বে ওয়াসা।’
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় লোকজনের পক্ষে মামলার বাদি ছৈয়দ মুহাম্মদ এনামুল হক মুনিরী দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘সরকারি কোন প্রকল্প কাজে বাধা দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তৎকালীন সময়ে হালিশহরে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম অসম্পূর্ণ ছিল। জেলা প্রশাসন সকল ভূমি মালিকদের ভূমির মূল্য পুরোপুরি পরিশোধ করেনি। পরবর্তীতে এই অধিগ্রহণ বাতিলও করা হয়। এ ব্যাপারে মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট মামলা এবং সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করলে আদালত আমাদের পক্ষে রায় দেয়। তাই এই জায়গার মালিক স্থানীয়রা। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের ওই রিপোর্টের বিরুদ্ধেও আমরা ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি।’

প্রসঙ্গত, সুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পুরো শহরকে ৬টি জোনে ভাগ করে প্রকল্প গ্রহণ করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। তাতে জোন-১ এর অধীনে সুয়ারেজের ওপর প্রথম প্রকল্প হালিশহরে অধিগ্রহণকৃত জায়গায় বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর একনেকে অনুমোদন পায়। তিন হাজার ৮০৮ কোটি ৫৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ হলে চট্টগ্রাম শহরে এটিই হবে সুয়ারেজের ওপর ওয়াসার প্রথম প্রকল্প। প্রতিষ্ঠার ৫৭ বছর পর বাংলাদেশ সরকার ও ওয়াসার যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এর আগে চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরীতে শুধু পানি সরবরাহ করেছে। সুয়ারেজ বা পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারেনি।

প্রসঙ্গত, ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (সিওয়াসা) প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ৫৭ বছরে ওয়াসা শুধুমাত্র পানি সরবরাহের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে নগরীর সব রকমের বর্জ্য সরাসরি নালা ও খাল হয়ে কর্ণফুলী ও হালদা নদী এবং বঙ্গোপসাগরে পড়ছে। তাতে দূষিত হচ্ছে নদী ও সাগর। এ অবস্থায় সুয়ারেজ প্রকল্পটি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে গেলে স্থানীয় লোকজনের বাধার কারণে প্রকল্পটি হুমকির মুখে পড়েছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট