চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

এনআইডি জালিয়াতি

রহস্যেঘেরা ইসি’র তদন্ত

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:৪৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে আসছে ইসি’র টিম
প্রশিক্ষণের ফাঁকে হয়তো
তদন্ত করতে পারে :
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা

জালিয়াতির মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরির বিষয়ে কূল-কিনারা পায়নি জেলা নির্বাচন কমিশনের গঠিত তদন্ত কমিটি। এরইমধ্যে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসছে টেকনিকেল বিশেষজ্ঞ টিম। ইসির সুরক্ষিত সার্ভার কিভাবে সুরক্ষা করা হবে সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবেন ঢাকার টিম।

এদিকে নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, থানা ও উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে নির্ধারিত আইপি নাম্বারধারী ইন্টারনেট মডেম রয়েছে। মডেম ছাড়াও ইসির নির্ধারিত পাসওয়ার্ডধারী ল্যাপটপ বা কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কার্যালয়ে। নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত আইপি নাম্বারধারী মডেম বা ল্যাপটপ ছাড়া কেন্দ্রীয় সুরক্ষিত সার্ভারে কোন তথ্য আপলোড করা যাবে না। কোন ল্যাপটপ বা আইপি থেকে কেন্দ্রীয় সার্ভারে আপলোড করা হয়েছে, তা শনাক্ত করার জন্য ইসির ঢাকা কার্যালয়ের টেকনিকেল বিশেষজ্ঞ টিম শনাক্ত করতে পারবে। যা ঢাকায় বসেই শনাক্ত করা যাবে বলে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। প্রশিক্ষণের নামে বা তদন্ত নিয়ে লুকোচুরি ঘটনায় রহস্যের দানা বেঁধেছে খোদ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে।
চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটি ইতিপূর্বে টেকনিকেল বিশেষজ্ঞ ছাড়া ভুয়া এনআইডি তৈরির সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা যাবে না বলে ইতিপূর্বে জানিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘৫ জনের একটি টিম টেকনিকেল কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিতে চট্টগ্রাম আসছেন। প্রশিক্ষণের ফাঁকে হয় তো তদন্তের কাজও করতে পারে। সার্ভার সুরক্ষা বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরজন্য থানা বা উপজেলা কার্যালয়ে ব্যবহৃত ল্যাপটপ সঙ্গে আনার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।’
জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্টের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সার্ভার কিভাবে সুরক্ষা করা যায়, সেই বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এখন টেকনিকেল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ টিম তদন্ত করবেন। কোন ল্যাপটপ থেকে কিভাবে আপলোড করা হয়েছে, বিষয়টি তারা খুঁজে বের করতে পারবেন।’
গত ১৮ আগস্ট লাকী নামে এক রোহিঙ্গা নারী জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য হাটহাজারী নির্বাচন অফিসে যান। আইডি কার্ড নিয়ে সন্দেহ হলে পরদিন জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আনা হয়। ইসির সার্ভারে লাকীর যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ রয়েছে বলে দেখা যায়। কিন্তু হাটহাজারী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্যে লাকী নামে কোন এনআইডি ইস্যু করা হয়নি। এভাবে ভুয়া এনআইডি তৈরির জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ পায়।

লাকী স্বীকার করেন, লাকীর প্রকৃত নাম রমজান বিবি। ২০১৪ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার পর টেকনাফের মুচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছিলেন। ওই রোহিঙ্গা নারী ভুয়া ঠিকানা দিয়ে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র করেছেন। জালিয়াতির মাধ্যমে করা এনআইডি’র তথ্য চট্টগ্রাম বা উপজেলায় না থাকলেও কমিশনের জাতীয় তথ্যভান্ডারে রয়েছে। ভয়ংকর এই জালিয়াতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। লাকীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয় কোতোয়ালী থানায়।
ইসির সুরক্ষিত সার্ভারে ভুয়া এনআইডি তৈরির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি এরকম আরও ৪৬টি ভুয়া এনআইডির তথ্য খুঁজে পায়। কিন্তু ভুয়া এনআইডি তৈরির সঙ্গে জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি তদন্ত কমিটি। তাই সুপারিশমালা পেশ করেই তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দেন।
এ বিষয়ে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান বলেন, ‘এক রোহিঙ্গা নারীর ভুয়া এনআইডি খুঁজতে গিয়ে আরও ৪৬টি ভুয়া এনআইডি খুঁজে পাওয়া গেছে। যেগুলো কাজগপত্র নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই।’
সার্ভারে ভুয়া এনআইডি কিভাবে দেখা যাচ্ছে তা শনাক্ত করা যায়নি বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, টেকনিকেল বিশেষজ্ঞ টিম টেকনিকেল বিষয়টি খুঁজে দেখবেন।

ইসি সূত্র জানায়, ইসির সুরক্ষিত সার্ভারে ভুয়া এনআইডি তৈরির পর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। এই ধরনের জালিয়াতির ঘটনারোধ এবং জালিয়াতির তদন্তে সারাদেশে টিম পাঠানো হচ্ছে। দেশের ৬৪ জেলাকে ১০টি জোনে ভাগ করে ঢাকা থেকে টেকনিকেল টিম সারাদেশে ইসি’র কার্যালয়ের টেকনিকেল কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেবে। সুরক্ষিত সার্ভার সুরক্ষার জন্য এই ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
নির্বাচন কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা সফটওয়ার সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ছাড়া ইসির সুরক্ষিত সার্ভারে আপলোড করা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ কমিশনের প্রতিটি কম্পিউটারে আলাদা আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) নম্বর রয়েছে। সেই আইপি নাম্বার ছাড়া কমিশনের কেন্দ্রীয় সার্ভারে আপলোড করা সম্ভব নয়।

চট্টগ্রাম সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুনির হোসাইন খান এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে পূর্বকোণকে বলেছিলেন, ‘কমিশনের লাইসেন্স ছাড়া অন্য কোন কম্পিউটার থেকে তা আপলোড কার যাবে না।’
ল্যাপটপে ঘুরপাক : নির্বাচন কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী সূত্র জানায়, প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিটি থানা বা উপজেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের ল্যাপটপ আনার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। বিশেষ করে যে ল্যাপটপ থেকে ইসি কেন্দ্রীয় সুরক্ষিত সার্ভারে ভোটার সংক্রান্ত তথ্যাদি আপলোড করা হয়, এসব ল্যাপটপ আনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, কমিশনের লাইসেন্সধারী যে কোন ল্যাপটপ থেকে ইসি কেন্দ্রীয় সার্ভারে তথ্য পাঠানো যায়। প্রতিটি অফিসে একাধিক ল্যাপটপ বা কম্পিউটার রয়েছে। এমনকি চারটি পর্যন্ত ল্যাপটপ বা কম্পিউটার রয়েছে। সেখান থেকে একটি ল্যাপটপ আনা হলে তদন্ত কমিটি রহস্য উন্মোচনে জটিলতায় পড়ে যাবেন তদন্ত কমিটি। এছাড়াও জালিয়াতি কাজে ব্যবহৃত ল্যাপটপ প্রশিক্ষণে না আনলে তদন্ত কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর আশঙ্কা রয়েছে। কর্মকর্তাদের দাবি, ঢাকায় কেন্দ্রীয় সার্ভারের মাধ্যমে তা খুঁজে বের করার সুযোগ রয়েছে।

ভুয়ার পাশে বৈধ ভোটার : লাকীর ভোটার সিরিয়াল নম্বর-১৭৬১। সেই তথ্য যাচাই করতে একটি বইয়ের অন্যান্য নাম্বারও যাচাই করা হয়। একই সিরিয়ালের বইতে ৪৬টি ভুয়া এনআইডি তৈরির তথ্য পায় তদন্ত কমিটি। চট্টগ্রামের হাটহাজারী, চন্দনাইশ, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, কোতোয়ালী, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, বায়েজিদ, খুলশী, বাকলিয়া, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর সেনবাগ, চরজগবন্ধু কমলনগর, রাঙামাটির লংগদু, টেকনাফ, টেকনাফের হৃীলাসহ চট্টগ্রাম বিভাগে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এসব ভুয়া ভোটার। কিন্তু এক সিরিয়ারের বই একাধিক উপজেলা বা স্থানে ভোটার হওয়ার কথা নয়। সাধারণত একই সিরিয়ালের ২নং ফরম একটি নির্দিষ্ট ভোটার এলাকায় পাঠানো হয়। ভুয়া ভোটার ছাড়াও একই সিরিয়ালের বইয়ে বৈধ ভোটারও রয়েছে বলে জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে। সেই সূত্র ধরেই তদন্ত কমিটি এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে দাবি তার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট