চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাস্তবায়িত হয়নি ৩৬ সুপারিশের একটিও

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১১ জুন, ২০২৩ | ১২:১৭ অপরাহ্ণ

ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, পাহাড় কাটা বন্ধ এবং ৩৬ দফা সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। গত ৩ এপ্রিল পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বশেষ (২৬তম) সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৫ সালে ১৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ১৪তম সভায়ও বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি সভায় এ ধরনের নানা সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না।

 

২০০৭ সালের ১১ জুন লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসে মারা গিয়েছিলেন ১২৭ জন। একই দিন নগরের আরও আট স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছিল।

 

এই পাহাড় ধসের পর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে গঠন করা হয়েছিল পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সদস্য সচিব করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম ও পরিবেশ অধিদপ্তর পৃথক দুটি কারিগরি রিপোর্ট প্রদান করেছিল।

 

তদন্ত কমিটিগুলো ভূমিধসের ২৮ কারণ চিহ্নিত করেছিল। পাহাড় সুরক্ষায় ৩৬ সুপারিশমালা প্রদান করে। পাহাড়ধস রক্ষায় দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প মেয়াদি সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ১৬ বছরে একটি সুপারিশও বাস্তবায়িত হয়নি।

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সহ-সভাপতি প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী পূর্বকোণকে বলেন, ‘১৬ বছরে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৬টি সভা করেছে। কিন্তু একটি সিদ্ধান্তও বায়স্তবায়ন হয়নি। আমলাতন্ত্র যে কাজ হাতে নেয় তা দীর্ঘসূত্রতা লেগে থাকে। সরকারি আমলা আসে আমলা যায়। কিন্তু ১৬ বছরেও ৩৬ দফা সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। এসব কারণে চট্টগ্রামে পাহাড়ধস ও হতাহতের ঘটনা লেগেই রয়েছে। মাঝখানে দু-তিন বছর ছাড়া প্রতিবছরই কম বৃষ্টিতেও পাহাড় ধসে মানুষ মারা গেছে।’

 

ব্যবস্থাপনার কমিটির সিদ্ধান্ত

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির বিভিন্ন সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালে ৩০টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকা করা হয়েছিল। এতে ৬৬৬টি পরিবারের বসবাস ছিল। অবৈধ বসতি উচ্ছেদের জন্য অবৈধ বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়। কমিটির সভাপতি তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ পাহাড়ধসের বিপর্যয়ের আগে টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দেন। কমিটির ১৯তম সভায় বলা হয়, ১৭ পাহাড়ে ৮৩৫ পরিবারের বসবাস রয়েছে। সর্বশেষ গত ৩ এপ্রিল ২৬তম সভায়।

 

এছাড়াও নগরীর মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ের পাদদেশে ৪-৫ তলা ভবনও রয়েছে। অবৈধভাবে দখল করে বস্তিঘর ও ভবন তৈরি করা হয়েছে। অন্তত আটটি সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। রয়েছে ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করার।

 

সরেজিমনে দেখা যায়, নগরের মতিঝর্ণা, বাটালি হিল, আকবর শাহ, অক্সিজেনসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটার উৎসব চলে আসছে। এসব এলাকায় প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে গড়ে ওঠছে নানা ধরনের স্থাপনা। বাড়ছে বসতি। অধিকাংশ পাহাড়ে রয়েছে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ। জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা জড়িত থাকায় পাহাড় দখল ও পাহাড় কাটা রোধ করা যাচ্ছে না বলে দাবি পরিবেশবাদীদের। সম্প্রতি আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কাটার দায়ে পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

 

ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ আমল থেকে পাহাড় কাটা শুরু হয়। পাহাড় কেটে বানানো হয় বাংলো, অফিস-আদালত। পাকিস্তান আমলেও পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরও পাহাড় কাটা থেমে নেই। ’৯০ এর দশকের থেকে পাহাড় কাটা রীতিমতো মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় কেটে বসতি গড়ে ওঠেছে। নির্মাণ করা হয় নানা স্থাপনা।

 

এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৬০ সালে নগর ও আশপাশে ২০০টি ছোট-বড় পাহাড় ছিল। বেশির ভাগ পাহাড়ের মালিক সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। ৫৭ শতাংশ পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৮৮টি পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আংশিক কাটা হয়েছে ৯৫টি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক দুটি গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া যায়।

 

পাহাড়ধস ঠেকাতে ৩৬ সুপারিশ

৩৬ সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল : পাহাড়ে জরুরিভাবে বনায়ন, গাইড ওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা, পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারণের ব্যবস্থা করা, বসতি স্থাপনাসমূহ টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না দেয়া, মতিঝর্না ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনা নিষিদ্ধ করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি।

 

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের পর থেকে গত ১৬ বছরে পাহাড়ধসে অন্তত দু’শ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট