চট্টগ্রাম ওয়াসার পানিতে লবণাক্ততা সমস্যা প্রায় দুই যুগের। কিন্তু বিকল্প খোঁজা হয়নি কখনো। বেহাল পরিস্থিতিতে বৃষ্টির দিকে চেয়ে থাকে সরকারি সেবা সংস্থাটি।
পানি বিশেষজ্ঞের অভিমত, নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে লবণাক্ততার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকার কারণে দীর্ঘদিনের সমস্যাটি আজো সমাধান করা যায়নি। উল্টো নদীর পানিতে লবণাক্ততা প্রতিবছরই বাড়ছে। অন্যান্য বছর লবণের স্থায়িত্ব কম থাকলেও, এ বছর তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে বেশি। তাই নগরবাসীর ভোগন্তি বেড়েছে বেশি।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত পানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘ওয়াসার পানিতে লবণ, এটা নতুন কিছু নয়। এ সমস্যা সমাধান ওয়াসাকেই বের করতে হবে। নতুন প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে কনসালট্যান্টদের মতামত নিয়ে থাকে ওয়াসা। নিশ্চিয় লবণের বিষয়টি নিয়েও ওইসময়ে কলসালট্যান্টদের মতামত রয়েছে। কিন্তু এতদিনেও সমস্যাটি সমাধান না হওয়া দুঃখজনক। ভবিষ্যতে ওয়াসার পানিতে লবণের পরিমাণ আরো বাড়বে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে লবণাক্ততা দূরীকরণে ওয়াসাকে কাজ করতে হবে।’
চট্টগ্রাম ওয়াসা হালদা নদী থেকে মোহরা পানি শোধনাগার ও মদুনাঘাটস্থ শেখ রাসেল পানি শোধনাগার প্রকল্পের মাধ্যমে নগরীতে দৈনিক ১৮ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে। কিন্তু এ দুইটি প্রকল্পের সরবরাহকৃত পানিতে গত দেড় মাস ধরে মাত্রাতিরিক্ত লবণ পাওয়া যাচ্ছে। যা মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
ওয়াসার তথ্য মতে, মোহরা পানি শোধনাগারে ইনটেকে জোয়ারের সময় (নদীর যে জায়গা থেকে পানি উত্তোলন করা হয়) প্রতি লিটার পানিতে ৩৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণ পাওয়া যাচ্ছে। একই অবস্থা মদুনাঘাট শেখ রাসেল পানি শোধনাগারেও। এ প্রকল্পের ইনটেকে পাওয়া যাচ্ছে প্রতি লিটারে ২০০০ মিলিগ্রাম। এ অবস্থায় দৈনিক ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পানি শোধনাগার দুইটি বন্ধ রাখতে হচ্ছে। যদিও ভাটার সময় লবণের মাত্রা থাকে তুলনামূলক কম। ওয়াসা ওইসময়ে পানি উত্তোলন করে নগরীতে সরবরাহ করে থাকে। বর্তমানে নগরীতে এ দুইটি প্রকল্প থেকে সরবরাহকৃত পানিতে লবণের মাত্রা থাকছে প্রতি লিটারে ৪০০ থেকে ৪৫০ মিলিগ্রাম। চিকিৎসরা বলছেন- ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি পান করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। তাই ঝুঁকি এড়াতে বিকল্প পানি পান করতে হবে।
ওয়াসা কর্মকর্তাদের মতে, বৃষ্টি হলে মিঠা পানি বাড়বে কাপ্তাইলেক, হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে। তখন নদীতে স্রোত বেড়ে গেলে সাগরের লবণ পানি উজানের দিকে আসতে পারবে না। তাতেই বন্ধ হবে ওয়াসার লবণ পানি সরবরাহ।
চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে ওয়াসার পানিতে লবণাক্ততা দেখা দেয়। তাতে দিশেহারা হয়ে পড়েন নগরবাসী। লবণ পানি পানের অনুপযুক্ত হওয়ায় বিকল্প হিসেবে অনেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে গভীর নলকূপের পানি এবং জার কিংবা মিনারেল ওয়াটার ব্যবহার করে আসছেন।
ওয়াসা সূত্র জানায়, গত কয়েক বছর পানিতে লবণের এ মাত্রা কম থাকলেও এবার হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি ছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। বৃষ্টি না হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদে পানির পরিমাণ কমে গেছে। কাপ্তাই হ্রদের পানি এসে পড়ে কর্ণফুলী নদীতে। পানির পরিমাণ কম হওয়ায় জোয়ারের সময় সাগরের লবণাক্ত পানি নদীর অনেক ভেতরে প্রবেশ করছে। এমন কি হালদা নদীর মোহরা ও মদুনাঘাট শেখ রাসেল পানি শোধনাগার থেকে ওয়াসা পরিশোধনের জন্য যে পানি সংগ্রহ করে সেখানে দ্রæত লবণ পানি চলে আসে। তাই নগরীর পানিতে লবণ পাওয়া যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ওয়াসার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা ছিল সারাবছরই কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কমপক্ষে দুইটি টারবাইন চালু রাখার। কিন্তু এ বছর তা ব্যত্যয় হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চারটি টারবাইন চালু রাখায় দ্রুত শেষ হয়ে যায় কাপ্তাইলেকের পানি। বর্তমানে কাপ্তাইলেকে পানির গভীরতা রয়েছে ৬৯ দশমিক ২ ফুট। যা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে ১০৯ ফুট। তাই লেক থেকে পানি নির্গত হচ্ছে না। এ অবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত লবণ পানির কারণে ওয়াসার মোহরা পানি শোধনাগার ও মদুনাঘাটস্থ শেখ রাসেল পানি শোধনাগার প্রকল্প দৈনিক ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তাতে মোহরা পানি শোধনাগারে দৈনিক ৯ কোটি লিটারের পরিবর্তে ৩ কোটি লিটার এবং মদুনাঘাটস্থ শেখ রাসেল পানি শোধনাগারে দৈনিক ৯ কোটি লিটারের পরিবর্তে সাড়ে ৬ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদন কম হওয়ায় নগরীতে রেশনিং করে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।’
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্ণফুলী ও হালদা নদীর ৪টি পানি শোধনাগারে দৈনিক ৪৬ কোটি লিটার পানি উত্তোলনের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু লবণাক্ততা ও কর্ণফুলী নদীতে শেওলা জমে যাওয়ায় এসব প্রকল্প থেকে পানি উৎপাদন হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ কোটি লিটার। তাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে রেশনিংয়ের পথ বেছে নিয়েছে ওয়াসা।
পূর্বকোণ/জেইউ