চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

অবহেলায় বেঘোরে যায় প্রাণ

ইমরান বিন ছবুর

১ এপ্রিল, ২০২৩ | ১২:০৩ অপরাহ্ণ

গত ৭ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) সকাল সাড়ে ১১টা। নগরীর কল্পলোক আবাসিক এলাকার ২নং সড়কের একটি নির্মাণাধীন আটতলা ভবনে কাজ করছিলেন ১২ জন শ্রমিক। ডি-ব্লকের মাহাবুবুর রহমানের নির্মাণাধীন ওই ভবনের ছাদে কাজ করছিলেন তিন শ্রমিক। মাচাংয়ের উপর দাঁড়িয়ে সিলিংয়ে কাজ করার এক পর্যায়ে মাচাং ভেঙে যায়। এ সময় ওই ভবনে কোন নিরাপত্তা বেস্টনি বা শ্রমিকদের বেল্ট না থাকায় তিনজন শ্রমিকই আটতলা থেকে নিচে পড়ে যান। তিন শ্রমিকের মধ্যে সাকিম আলী ও মো. ই¯্রাফিল ঘটনাস্থলে এবং মো. রিপন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। নিহত তিন শ্রমিকের বয়সই ২০ বছর। কাজ করার সময় ভবন মালিক বা ঠিকাদার যদি শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখতেন, তাহলে ওই তিন নির্মাণ শ্রমিক নিশ্চিত প্রাণে বেঁচে যেতেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করতে গিয়ে সাকিম আলী, ই¯্রাফিল ও রিপনের মত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। এছাড়া, অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করছেন। নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের দাবি, নির্মাণাধীন ভবনে শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করার ফলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। ভবন মালিক ও ঠিকাদারের অবহেলার কারণে প্রাণ যাচ্ছে নির্মাণ শ্রমিকদের। অন্যদিকে, নিরাপত্তার ব্যাপারে মালিক-শ্রমিক সচেতন হলে এসব দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

২০০৬ সালের শ্রম আইনের ৭৮ (ক) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ‘শ্রমিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা ব্যতীত কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।’ আইনে এমন বাধ্যবাধকতা থাকলেও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় একাধিক নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র।

 

নগরীর বাকলিয়া থানাধীন কল্পলোক আবাসিক এলাকা, কোতোয়ালী থানাধীন সিটি কলেজ সংলগ্ন আইস ফ্যাক্টরি রোড, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকদের জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ছাড়াই নির্মাণাধীন রয়েছে অসংখ্য বহুতল ভবন। সেসব ভবনে হেলমেট, গামবুট, নিরাপত্তা বেল্টসহ নিরাপত্তা উপকরণ ছাড়াই শ্রমিকদের কাজ করতে দেখা যায়।

 

একাধিক নির্মাণ শ্রমিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, আমাদের দেশে দুর্ঘটনাজনিত সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করেন পরিবহন শ্রমিক। এরপর দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকের তালিকায় রয়েছে নির্মাণ শ্রমিক। রাজমিস্ত্রী ও রঙ মিস্ত্রীদের কাজ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আস্তর ও রং করার ক্ষেত্রে দেয়ালের বাইরে থেকে বাঁশের মাচায় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। নিচে জাল না দেওয়া বা বেল্ট ব্যবহার না করার কারণে পা পিছলে বা মাচা ভেঙে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা।

 

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম জেলায় গত দুই বছরে ১০টি দুর্ঘটনার তথ্য এই সংস্থা লিপিবদ্ধ করেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৭ জন নির্মাণ শ্রমিক নিহত এবং ৩ জন আহত হয়েছেন। হতাহতের শিকার হওয়া শ্রমিক ও তাদের পরিবারের করা সাহায্যের আবেদনের প্রেক্ষিতে অধিদপ্তর এ তথ্য লিপিবদ্ধ করে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে ১০টি দুর্ঘটনার বিপরীতে সাহায্যের জন্য আবেদনের তথ্য থাকলেও বাস্তবে দুর্ঘটনার সংখ্যা এর কয়েকগুণ হবে বলে মনে করছেন নির্মাণ শ্রমিক নেতৃবৃন্দ।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ লেবার ইন্সটিটিউটের (বিলস) চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান এম নাজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের দেশে দুর্ঘটনা জনিত সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করেন পরিবহন শ্রমিক। পরিবহন শ্রমিকের পর দুর্ঘটনা জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকদের তালিকায় রয়েছে নির্মাণ শ্রমিক। শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না রেখেই অধিকাংশ ভবন মালিক শ্রমিকদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। যার ফলে একের পর এক দুর্ঘটনায় নির্মাণ শ্রমিকদের প্রাণহানি বা চিরতের পঙ্গুত্ববরণ করছেন।  এরপর দুর্ঘটনা জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকের তালিকায় রয়েছে নির্মাণ শ্রমিক।

 

রিয়েল এস্টেট এন্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) চট্টগ্রাম রিজিওন্যাল কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল কৈয়ুম চৌধুরী বলেন, রিহ্যাবের সদস্যরা শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেই কাজে নিয়োগ দেন। সব ব্যবসায়ীদের মানসিকতা তো এক না। সেক্ষেত্রে রিহ্যাবের সদস্যবৃন্দ শতভাগ না হলেও ৮০-৯০ ভাগ শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেই কাজে নিয়োগ দেন। কিন্তু রিহ্যাবের বাইরেও অনেক আবাসন ব্যবসায়ী রয়েছেন। এছাড়া, একক ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং সমিতির মাধ্যমেও ভবন নির্মাণ করা হয়। যাদের অনেকেই শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন না। ফলে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনা ঘটছে।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট