চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

আলোর মুখ দেখছে বার্ন হাসপাতাল

নিজস্ব প্রতিবেদক

৩১ মার্চ, ২০২৩ | ৪:১০ অপরাহ্ণ

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে চট্টগ্রামে চীন সরকারের সহায়তায় দেড়শ’ শয্যার বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতাল স্থাপনে দু’দেশের চুক্তি সই হয়েছে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) দুপুরে সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়। ফলে দীর্ঘ প্রতীক্ষার বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতাল বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামী দু’সপ্তাহ পর চীনা সদস্যদের একটি প্রতিনিধি দল হাসপাতাল নির্মাণে সয়েল টেস্টসহ আরও আনুষাঙ্গিক কার্যক্রম শুরু করবেন। প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে চমেক হাসপাতালের গোয়াছি বাগান এলাকায় ১৫০ শয্যার বিশেষায়িত এ হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ পুরোদমে শুরু করবেন চীনা প্রকৌশলীরা। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী দুই বছরের মধ্যে বিশেষায়িত হাসপাতালটি আলোরমুখ দেখবে বলেও আশাবাদ তাঁদের।
এর আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারির চট্টগ্রামে আসেন চীনের ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল। তাঁরা চমেক হাসপাতালের গোয়াছিবাগান এলাকার জমিটি পরিদর্শন ও ডিজিটাল সার্ভেসহ নকশা প্রণয়নের কাজও করেন। পরবর্তীতে প্রাথমিক কাজ শেষে গত ১১ মার্চ ‘ইনস্পপেকশনাল মিনিটস’ শীর্ষক সমঝোতা স্বাক্ষরও করেন চীনা দল। এরপরই গতকাল (বৃহস্পতিবার) সচিবালয়ে দু’দেশের সাথে হাসপাতাল নির্মাণের চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়।
চুক্তির আওতায় চীন সরকারের সম্পূর্ণ অনুদান ও সহায়তায় চমেক হাসপাতালে ১৫০ শয্যার বার্ন এবং প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপিত হবে। বার্ন এবং প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র চীন সরকার অনুদান সহায়তা হিসেবে দেবে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, ‘কিছুদিন পূর্বে চীনের একটি টিম প্রকল্প এলাকায় এসে হাসপাতালের সার্ভের পাশাপাশি নকশার কাজও করেন। তবে ওই সময়ে স্থাপনা থাকার কারণে নকশা পূর্ণাঙ্গ করতে পারেননি। যার কারণে চীনা দল আবারও চট্টগ্রামে আসবেন। তাদের প্রায় ৪০ জনের একটি দল চট্টগ্রামে থেকেই এসকল কাজ চালিয়ে যাবেন। চূড়ান্ত নকশা অনুমোদন হওয়ার পরপরই আমারা তাদের জায়গা বুঝিয়ে দেব। যদিও এখন প্রকল্প এলাকার চারদিকে বাউন্ডারি দিয়ে দেয়া হবে।’
অন্যদিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন পূর্বকোণকে বলেন, ‘সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই চীনা প্রকৌশলীরা সয়েল টেস্টের কাজ শুরু করবে। ঈদের পরপরই তারা পুরোদমে কাজ শুরু করবে। চীনা দল আশাবাদী আগামী দু’বছরের মধ্যেই হাসপাতালটির কাজ শেষ করতে।’
জানা যায়, বৃহস্পতিবার (গতকাল) দুপুরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং চায়না ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এইচ ই ডেং বোকিংয়ের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়োর হোসেন হাওলাদার এবং চীন সরকারের পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তি সই অনুষ্ঠানে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার খুরশিদ আলম, বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসানসহ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যদপ্তর এবং ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং চীনের একটি এক্সপার্ট টিম উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে বিশেষায়িত বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতাল নির্মাণে ২০১৪ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর পর বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায় চীন। সে সময় চীনের একটি প্রতিনিধি দল স্থান নির্বাচনের জন্য চট্টগ্রামে এসেছিল। তবে স্থান নির্ধারণ করতে না পারাসহ নানা জটিলতায় কাজ আর এগোয়নি। প্রায় দুই বছর পর ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে চমেক হাসপাতাল এলাকায় সম্ভাব্য জায়গা পরিদর্শনে আসে চীন সরকারের ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল। পরিদর্শনে তারা হাসপাতালের বর্তমান বার্ন ইউনিটের পেছনের খালি জায়গায় বিশেষায়িত এ ইউনিট করার কথা জানালে তৎকালীন পরিচালক সম্মতি দেন। যার প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ বাংলাদেশস্থ চীনা দূতাবাসের পক্ষ থেকে অন্য আরেকটি চিঠিতে চট্টগ্রামে সম্পূর্ণ আলাদা বিশেষায়িত একশ’ শয্যার বার্ন ইউনিট করার আগ্রহ প্রকাশ করে দেশটি। পরবর্তীতে তারা প্রায় চার হাজার বর্গফুট জায়গায় চারতলা বিশিষ্ট এক’শ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল করতে সকল রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। একই সাথে নকশাও তৈরি করেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার এসে পরিমাপ করে কম জায়গা পাওয়ায় এ নিয়ে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়।
২০১৯ সালের ১৫ মার্চ চতুর্থবারের মতো চীনা প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সাথে কয়েক দফা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতেও কোনরকম সুরাহা না মেলায় ফেরত যায় চীনের প্রতিনিধিরা। এ নিয়ে স্বয়ং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার আলোচনা হলেও প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করতে রাজি হয়নি চীন। যার কারণে চট্টগ্রামে বার্ন ইউনিট পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যদিও শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের ২০ জুলাই এক বৈঠকে চীন সরকারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে ‘বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ বার্ন হাসপাতাল’ নির্মাণের প্রস্তাব দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত। ফলে পুনরায় আশার আলো দেখা মেলে।

 

বার্ন হাসপাতাল বঙ্গমাতা শেখ
ফজিলাতুন নেছা মুজিবের
নামে উৎসর্গ করতে চাই
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল
শিক্ষা উপমন্ত্রী ও সভাপতি
ব্যবস্থাপনা কমিটি, চমেক হাসপাতাল

‘জায়গার জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে চট্টগ্রামের বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতাল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানান জটিলতা ছিল। একসময় চীন সরকার এ কারণে চলেও যান। তবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চট্টগ্রামবাসী কৃতজ্ঞ, তিনি নিজেই ডা. সামন্তলাল সেনকে দিয়ে এ প্রকল্পটা চট্টগ্রামে বাস্তবায়ন করিয়েছেন। কোনভাবেই এ বিষয়ে তিনি হাল ছাড়েননি। আজ চট্টগ্রামবাসী আনন্দিত এবং প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে কৃতজ্ঞ। পাশাপাশি জায়গার সংকটসহ নানা বাধা বিপত্তির পরও ডা. সামন্ত লাল সেন এককভাবে যে ভূমিকা নিয়েছেন এবং হাসপাতালটি বাস্তবায়নে অবদান রেখেছেন তা সারাজীবন স্মরণ রাখবেন চট্টগ্রামবাসী। তবে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হিসেবে আমার দাবি হচ্ছে বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতালটি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নামে উৎসর্গ করতে চাই।’

বার্ন হাসপাতাল আলোর মুখ
দেখতে যাচ্ছে, এর চেয়ে
বড় প্রাপ্তি আর কী আছে
অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন
প্রধান সমন্বয়ক
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক
সার্জারি ইনস্টিটিউট

‘অনেক লড়াই করার পর শেষ পর্যন্ত চুক্তি হয়েছে, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই নেই। আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) শিক্ষার্থী ছিলাম। আমার আবেগের জায়গা হচ্ছে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের মাটিতে পড়াশোনা করে আমি আজকের এই জায়গায় এসেছি। দীর্ঘ বছর চেষ্টার পর চুক্তির মাধ্যমে বার্ন হাসপাতালের আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে। আমারও একটা দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রামবাসীর জন্য কিছু করার। আমি তার জন্য চেষ্টা করে গেছি।’
‘পোড়া রোগীদের নিয়ে কাজ করার সুবাদে আমি দেখেছি বহু রোগী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথিমধ্যেই রাস্তাতে মারা গেছে। ঢাকার পর চট্টগ্রাম হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এ অঞ্চলে প্রতিনিয়তই কোন না কোন বার্ন দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। তবে চুক্তির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামবাসী বিশেষায়িত একটি হাসপাতাল পেতে যাচ্ছে। যা যুগান্তকারী হবে। আধুনিক হাসপাতাল স্থাপনের মাধ্যমে আইসিইউ কিংবা চিকিৎসার অভাবে আর কোন মৃত্যুর খবর অন্তত পাওয়া যাবে না। আমি সবসময় স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের কোথাও কোন রোগী যেন বিনাচিকিৎসায় মারা না যায়।’

 

সারাদেশের মানুষ
বিশেষায়িত সেবা গ্রহণ
করতে পারবেন
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান
পরিচালক, চমেক হাসপাতাল

‘বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতাল নির্মাণের জন্য অনেক বাধা বিপত্তি ছিল। আমার দায়িত্ব গ্রহণের পর গেল একটি বছর এ হাসপাতালের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে গেছি। পরপর বড় দুটি দুর্ঘটনা চোখের সামনে দেখেছি। অনুভব করেছি, বার্ন হাসপাতালের কত প্রয়োজন রয়েছে এ চট্টগ্রামের। অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতাল। যেখানে শুধুমাত্র চট্টগ্রামবাসী নয়, সারাদেশের মানুষ বিশেষায়িত সেবা গ্রহণ করবে পারবেন। চুক্তি হওয়ার পর খুব শীঘ্রই চীনা দল হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করবে।’

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট