চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সমাজকে ভুল প্রমাণ করেছেন নীতু বসাক

নিজস্ব প্রতিবেদক

৮ মার্চ, ২০২৩ | ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ

বগুড়ার মেয়ে নীতু বসাক বর্তমানে মেইনটেন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশের (ইউবিএল) চট্টগ্রামের কালুরঘাট ফ্যাক্টরিতে। দেশের শীর্ষস্থানীয় নিত্যব্যবহার্য কোম্পানি এবং সবচেয়ে বড় সাবান প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের একই বিভাগে প্রথম নারী মেইনটেন্যান্স ম্যানেজার হতে পারাটা তার জন্য গর্বের বিষয়। কিন্তু এ পথটুকু পাড়ি দেওয়া নীতুর জন্য সহজ ছিল না। পরিবারে কোনো ভাই না থাকায় সামাজের নানা নেতিবাচক কথা শুনে শুনে তাকে বড় হতে হয়েছে। তবে নীতু মানুষের কথায় কান না দিয়ে বরং সুশিক্ষা ও অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে নিজেকে বিকশিত করতে চেয়েছেন এবং হতে পেরেছেন প্রতিশ্রুতিশীল ও অনুপ্রেরণাদায়ী এক নারী।

 

বগুড়া শহরেই বেড়ে উঠা ও শিক্ষাজীবনের শুরু নীতুর। সেখানে তিনি বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক এবং বগুড়া আজিজুল হক কলেজ হতে উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। এরপর ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) থেকে।

 

স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরেই কর্পোরেট জগতে পা রাখেন নীতু বসাক। দেশের অন্যতম একটি বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে ক্যারিয়ার শুরুর পর ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জন করতে থাকেন তিনি। ধীরে ধীরে মেইনটেন্যান্স, ডিজাইনিং ও বিভিন্ন প্রোডাকশন মেশিনারিজকে ঘিরে তার কাজের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায়। ফার্মাসিউটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ দীর্ঘ ছয় বছরের অভিজ্ঞতা ও শেখার সুযোগ তার চলার পথকে গতিশীল করেছে।

 

নীতু ইউনিলিভারে যোগদান করেন ২০২১ সালের। প্রথমে একটি প্রোজেক্টে মেইনটেন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে সোপ ডিপার্টমেন্টে মেইনটেন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। ইউনিলিভারের সঙ্গে এই বছর দেড়েক এর পথচলায় নীতু কর্পোরেট জীবনকে আরো নতুন ও গভীরভাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে নারী ক্ষমতায়ন ও বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধিতে তাকে ইউনিলিভার বরাবরই সাহস ও উৎসাহ জুগিয়ে আসছে।

 

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইউনিলিভারে বাংলাদেশ যোগদানের পর হতেই দেখে আসছি এখানে নারী ম্যানেজারদের সমানভাবেই বিবেচনা করা হয়। এখানে কাজের নিরাপদ পরিবেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

 

চট্টগ্রামের কালুরঘাট ফ্যাক্টরিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নারী ম্যানেজাররা কাজ করে থাকেন। তাদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ। কর্মীদের জন্য রয়েছে রিলোকেশন সাপোর্ট, পিক-অ্যান্ড-ড্রপ সার্ভিস সহ আরো সুযোগ-সুবিধা।

 

নীতু বসাক জানান, ইউনিলিভার বাংলাদেশ নিজেকে প্রমাণে তার জন্য বড় একটি সুযোগ। দেশের সবচেয়ে বড় এফএমসিজি প্রতিষ্ঠানে বৃহৎ পরিসরে দায়িত্ব নিয়ে তাকে কাজ করতে হচ্ছে। একেবারে ভিন্ন পরিবেশে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোম্পানি সবসময় নারী কর্মীদের সব রকমের সহযোগিতা দিয়ে পাশে রয়েছে।

 

নারী হিসেবে ছোটবেলা থেকেই সংগ্রাম করে বড় হতে হয়েছে নীতুকে। সমাজের মানুষজন ছেলেদের সংসারের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখলেও মেয়েদের তেমনটি দেখতো না। যদিও এক্ষেত্রে নীতু সৌভাগ্যবান। পারিবারিকভাবে তাকে কখনো বৈষম্যের শিকার হতে হয়নি।

 

নীতু আরও বলেন, ‘আমি সৌভাগ্যবান যে বাবা-মা আমাকে সে তিক্ত অভিজ্ঞতা পেতে দেননি। তবে আমাদের পরিবারে শুধুই তিনবোন, কিন্তু কোনো ভাই না থাকায় সামাজের নানা নেতিবাচক কথা আমাদের শুনতে হয়েছে। আমার বাবা-মাকে বলা হতো আমাদের পড়াশোনায় যেন তারা অর্থ খরচ না করেন- কারণ ভাই না থাকায় বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে কে দেখবে এমনটাই বলত তারা।’

 

আজকে তার এই অর্জনে বাবা, মা ও বোনদের সবারই অবদান রয়েছে। বাবা তাকে পড়ালেখায় অনুপ্রেরণা দিয়েছে আর মা সবসময় মানসিকভাবে পাশে ছিলেন। পাশাপাশি বড় বোন পথ দেখিয়েছেন এবং ছোট বোন দায়িত্বশীল হতে শিখিয়েছে নীতুকে।

 

নীতু জানান, নারী হিসেবে এগিয়ে যেতে একটি ঘটনা তাকে প্রায়ই অনুপ্রাণিত করে। ২০১৮ সালে ভারতের আহমেদাবাদে তিনি একটি মেশিনের ফ্যাক্টরি অ্যাকসেপটেন্স টেস্টের জন্য গিয়েছিলেন। নীতু সেখানে একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের মেয়েদের সঙ্গে নিজের চলার পথের বাধা-বিপত্তি ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। কারণ সেখানের শীর্ষ সেলস ম্যানেজারের ধারণা ছিল তাদের কর্মীদের অনুপ্রেরণা প্রয়োজন। মেয়েরা নীতুর কথা শোনেন ও তাদের সম্ভাবনা উপলব্ধি করেন। এরপর নীতু বুঝতে পারেন তাকে আরো দূর যেতে হবে। শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যদের জন্যও।

 

নীতুর মতে বাংলাদেশের নারীরা শ্রমশক্তি ও রাজনীতিতে ভালো করছে। নারীর প্রতি সহিংসতাও কমেছে। নারীরা এখন কারখানায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, উদ্যোক্তা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা পালন করছে, বলা চলে নারীদের অবদান সর্বত্র। উপযুক্ত শিক্ষা ও আত্মসচেতনতা এসব পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে বলেই নীতুর ধারণা। তিনি আগামীতে এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চান- যেখানে লৈঙ্গিক পরিচয়ে কাউকে যেন বিচার করা না হয়।

 

নীতু বসাক বলেন, ‘প্রায়ই ভাবা হয় নারীরা কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং কাজগুলোর জন্য উপযুক্ত না। নারীদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, যাতে তারা এসব কথা কানে না দিয়ে আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী হতে শেখে। তাহলেই তারা সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে পারবে।’

 

ভবিষ্যত নারী প্রজন্মের জন্য নীতুর তিনটি উপদেশ হচ্ছে- প্রথমত, তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। কেবল সঠিক শিক্ষার মাধ্যমেই তারা সমাজে পক্ষপাতের দুষ্টচক্র ভাঙতে পারবে। দ্বিতীয়, নারীদের নির্ভরশীলতা পরিহার করার জন্য অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তৃতীয়ত, নারীদের যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, যাতে তারা নিজের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

পূর্বকোণ/পলাশ 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট