চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

উড়ে গেছে কারও হাত কারও মাথা রক্তাক্ত

নাজিম মুহাম্মদ

৫ মার্চ, ২০২৩ | ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ

বিকেল পাঁচটা থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপতালে আসতে থাকে একের পর এক এম্বুলেন্স। নামানো হচ্ছিল আহতদের। রক্তাক্ত মানুষগুলোর কারো পা থেতলে গেছে, কারও মাথায় আঘাত, আবার কারো চোখে গুরুতর জখম। এরমধ্যে দেখা গেল একজনের বাম বাহুর নিচের অংশ নেই। হয়তো বিস্ফোরণে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে হাতটি। বেরিয়ে গেছে নাড়িভুড়ি। আহতদের চিৎকারে ভারী হয়ে উঠে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) জরুরি বিভাগের বাতাস।

 

সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেসরকারি সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে গতকাল শনিবার বিকেল চারটায়। বিস্ফোরণের ঘটনার পর পরই আহতদের সেবা দিতে চমেক হাসপাতালে হাজির হয় জেলা প্রশাসন, রেডক্রিসেন্ট এবং গাউছিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবক দল। বিস্ফোরণস্থল থেকে এম্বুলেন্সে আসা আহতের দ্রুত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিতে সহায়তা করছিলেন।

 

রাত পৌনে এগারোটায় (এ প্রতিবেদন লেখার সময়) চট্টগ্রাম মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, সীতাকু-ে অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণে চমেক হাসপাতালে আহত অবস্থায় ২০ জনকে আনা হয়েছে। এছাড়াও নিহত হয়েছেন ছয়জন। চট্টগ্রাম মেডিকেলের পরিচালক আরও জানান, আহতদের চিকিৎসা সেবা দিতে মেডিকেলে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকদের ডেকে আনা হয়েছে। ব্লাড ব্যাংকে ৬৪ ব্যাগ রক্ত জমা আছে। এছাড়া মুমূর্ষুদের কারো আইসিইউ সেবা লাগলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ও ফৌজদারহাট হাসপাতালের আইসিইউ প্রস্তুুত রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে আমরা ইতিমধ্যে কথা বলে রেখেছি।

 

আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের : চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জানান, আহতদের চিকিৎসা দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। চিকিৎসার পাশাপাশি আহত ও নিহতদের পরিবারের খাবার সরবরাহ করবে জেলা প্রশাসন।

 

জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় নিহতদের পরিবার প্রতি ২৫ হাজার টাকা প্রদান করবে। এছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে নিহতদের পরিবার প্রতি ২৫ হাজার, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবার প্রতি দুই লাখ এবং আহতদের পরিবার প্রতি ৫০ হাজার টাকা সহায়তা দেবে। আহতদের  প্রতি পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ৭৫০০ টাকা প্রদান করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

 

এছাড়া হাসপাতালে আহত ও নিহতদের দেখতে আসেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মহিউদ্দিন, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ ও সিভিল সার্জন ইলিয়াছ  চৌধুরী।

 

বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠে আশেপাশের অন্তত তিন কিলোমিটার এলাকা। ভেঙ্গে যায় বেশ কিছু ভবনের কাঁচ। দেখা দিয়েছে দেয়ালে ফাটল। বিস্ফোরণের পর লোহার টুকরো,টিনের পাত উড়ে গিয়ে পড়ে আশেপাশের এলাকায়। সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের অন্তত আধ কিলোমিটার দূরে একটি দোকানে বসেছিলেন ভাটিয়ারি কদমরসুল জাহানাবাদ গ্রামের ইসমাইলের ছেলে শামছুল আলম (৫৬)।  শামছুলের বড়ভাই ওবায়দুর মোস্তফা জানান, ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে একটি লাকড়ির দোকানে বসেছিলেন শামসুল। হঠাৎ বিস্ফোরণস্থল থেকে উড়ে আসা প্রায় ২৫০-৩০০ কেজি ওজনের একটি লোহার টুকরো পড়ে শামছুলের মাথায়। তাঁর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।  ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।

 

অক্সিজেন প্ল্যান্টের গাড়ি চালকের সহকারীর কাজ করেন মোহাম্মদ ফরিদ। বিস্ফোরণে  মারা যান তিনি। নিহত ফরিদের বাড়ি ফৌজদারহাট বাংলাবাজার এলাকায়। দুপুরে শ্যালক আজম খানের সাথে ফোনে কথা হয় ফরিদের। সন্ধ্যায় এক ব্যক্তি ফোন করে ফরিদের স্ত্রী রাশেদাকে চমেক হাসপাতালে যেতে বলেন। হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে স্বামীকে খোঁজাখুঁজি করেন। পরে  মর্গে স্বামীর মরদেহের খোঁজ পান। স্বামীর মরদেহ দেখে হাসপাতালের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন রাশেদা। কাঁদছিলেন অঝোর ধারায়। বললেন,  সংসারে তাদের তিন মেয়ে। ফরিদের আয়ে চলত সংসার। এখন সংসার চলবে কী করে বলতে বলতেই ভেঙে পড়েন কান্নায়।

 

ঘটনার পর পরই চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে উপস্থিত হন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা সেবা দিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবকরা তিন শিফটে কাজ করবেন। আহতদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা সেবা দিতে তারা কাজ করবেন। উদ্ধার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত  জেলা প্রশাসন কাজ করে যাবে।

পূর্বকোণ/একে

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট