চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সেরা স্কুলে ‘ফলাফল বিপর্যয়’!

ইমরান বিন ছবুর

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:১৮ অপরাহ্ণ

‘লটারির মাধ্যমে ভর্তির’ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে চট্টগ্রাম নগরীর সেরা স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে। বেশিরভাগ স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করেছে একাধিক বিষয়ে। পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার নিয়ম চালু থাকা অবস্থায় ফেল করার এমন নজির আগে কখনো ঘটেনি। এমতাবস্থায় চাহিদাসম্পন্ন স্কুলের শিক্ষকরা আসন্ন এসএসসি পরীক্ষা- ২০২৩ নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। নগরীর সেরা স্কুলগুলোর একাধিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।

 

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, লটারি ভর্তির আগের বছরগুলোতে শিক্ষার্থীরা ভালো বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বছরের শুরু থেকে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতো। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রামের শীর্ষে থাকা বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতো। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পছন্দের প্রথম সারিতে থাকতো চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, মুসলিম হাই স্কুল, ড. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়সহ নগরীর ১০ সরকারি বিদ্যালয়ের সাথে নামকরা বেসরকারি বিদ্যালয়ও। তবে লটারির মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে যে কোন শিক্ষার্থী কোন রকমের প্রস্তুতি ছাড়াই লটারির মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

 

চট্টগ্রামের অন্যতম সেরা বিদ্যালয়গুলোর একটি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এন্ড কলেজ। বোর্ড পরীক্ষায় এই স্কুলের অবস্থান থাকে বরাবরই শীর্ষে। সম্প্রতি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান শিক্ষকের কক্ষের সামনে অর্ধশতাধিক অভিভাবক অবস্থান করছেন। তাদের প্রত্যেকের সন্তান বার্ষিক পরীক্ষায় চার বিষয়ের অধিক ফেল করেছে। অভিভাবকদের সবাই সন্তানের প্রমোশনের জন্য প্রধান শিক্ষকের কাছে অনুরোধ নিয়ে এসেছেন।

 

প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে আসা একাধিক অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, এসব নামকরা বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি সত্যিই ভালো পড়াতো, তাহলে শিক্ষার্থীরা এমন গণহারে ফেল করতো না। ভালো শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে নিজেদের ভালো দাবি করে স্কুলগুলো। স্কুলের যদি অবদান থাকতো, তাহলে তো আগের মত সব শিক্ষার্থী ভালো রেজাল্ট করতো।

 

কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে- নবম শ্রেণির একটি সেকশনে ৮৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২০ জনের মত শিক্ষার্থী সব বিষয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। বাকি শিক্ষার্থীরা কোন না কোন বিষয়ে ফেল করেছে। এরমধ্যে ৪-৫ বিষয়ে ফেল করেছে এমন শিক্ষার্থীও রয়েছে।

 

প্রায় একই রকম বর্ণনা দিয়েছে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও। তারা জানায়, সপ্তম শ্রেণির একটি সেকশনে ৮৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। সপ্তম শ্রেণির ১১টি বিষয়ের মধ্যে সব বিষয়ে পাস করেছে এমন শিক্ষার্থী প্রায় ২৫ জনের মত। বাকি শিক্ষার্থীরা কোন না কোন বিষয়ে ফেল করেছে। ১১টি বিষয়ের মধ্যে ৯টি বিষয়ে ফেল করেছে এমন শিক্ষার্থীও রয়েছে।

 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, লটারির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা অর্ধবার্ষিকী এবং বার্ষিক পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করেছে এটা সত্যি। আমাদের শিক্ষকরা সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। এরপরও কিছু শিক্ষার্থী ফেল করেছে। বিশেষ করে লটারিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরাই রেজাল্ট খারাপ করেছে।

 

তিনি আরো বলেন, আগে শুধুমাত্র ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই কলেজিয়েটে ভর্তির সুযোগ পেত। এখন লটারির মাধ্যমে যে কোন শিক্ষার্থীই ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। আগে বার্ষিক পরীক্ষায় আমাদের ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী সব বিষয়ে পাস করতো। এখন ফেলের সংখ্যাটা অনেক বেশি। এখন শিক্ষকের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

 

এদিকে মুসলিম হাই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ক শাখার ৭৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৯ জন শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে ফেল করেছে। যা ওই শাখার মোট শিক্ষার্থীর ৩৭ শতাংশের বেশি। ষষ্ঠ শ্রেণির খ শাখার ৭৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪২ জনই বিভিন্ন বিষয়ে ফেল করেছে। যা মোট শিক্ষার্থীর ৪২ শতাংশ। একইভাবে নবম শ্রেণির খ শাখার ৭৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৮ জন শিক্ষার্থী ফেল করেছে। যা মোট শিক্ষার্থীর ৬২ শতাংশের বেশি। একই শ্রেণির ঘ শাখার ৭১ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৭ জনই ফেল করেছে। যা মোট শিক্ষার্থীর ৬৬ শতাংশের বেশি।

 

মুসলিম হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মমতাজ আকতার বলেন, আগে ভর্তির পরীক্ষার মাধ্যমে শুধুমাত্র মেধাবী শিক্ষার্থীই মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেত। এখন লটারির মাধ্যমে সব ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। এখন যেহেতু সব ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীরা রয়েছে, তাদের এক ক্যাটাগরিতে আনতে আমাদের কিছুটা সময় লাগছে। আমাদের শিক্ষকরা যথেষ্ট আন্তরিক, অভিভাবকরাও সচেতন হলে শিক্ষার্থীরা ভালো রেজাল্ট করবে আশা করছি।

 

সরকারি বিদ্যালয়ের একাধিক প্রধান শিক্ষকদের দাবি, ফেল করা এসব শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই লটারির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া। গত ২৩ বছরের শিক্ষকতা জীবনে সরকারি বিদ্যালয়ে এমন ফেল দেখেননি বলে মন্তব্য করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রধান শিক্ষক।

 

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর হাসিনা জাকারিয়া বলেন, লটারির মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীরা সব বিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা একদিকে যেমন ভালো, অন্যদিকে অনেক সময় মেধাবীরা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে লটারিতে ভর্তির অন্য একটি ভালো দিক হচ্ছে লটারিতে ভর্তির মাধ্যমে অসুস্থ প্রতিযোগিতাও দূর হয়েছে। আর আমাদের শিক্ষকরা কেমন ভালো পড়ান সেটাও এখন সবাই জানতে পারবে।

 

দেশে করোনার প্রকোপ বাড়ার পর ২০২১ সাল থেকে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ভর্তি পরীক্ষার পরিবর্তে লটারির মাধ্যমে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০২১ সালে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন। চট্টগ্রাম বোর্ডে ভালো অবস্থানে থাকা বিদ্যালয়গুলো এবার তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছেন নগরীর শীর্ষে থাকা বিদ্যালয়ের প্রধানরা।

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট