চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অনুন্নত অবকাঠামোই প্রধান সমস্যা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৫:২২ অপরাহ্ণ

পাহাড়, নদী ও সাগরঘেরা বাঁশখালীর বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন। যার নিদর্শন ৪৫৫ বছরের বখশি হামিদ মসজিদ। বখশী হামিদ এই অঞ্চলের প্রাচীন জমিদার। মোগল ও পর্তুগীজ আমলে অনেক জমিদারের বসতি ছিল বলে এই অঞ্চলকে ‘জমিদারি’ জনপদও বলা হয়।

 

মোগল আমলের জলকদর খাল অনেক রাজা-বাদশা ও জমিদারের পদচারণায় ইতিহাস-সংস্কৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। কতটুকু এগুলো রাজা-বাদশা ও জমিদারের স্মৃতিধন্য বাঁশখালী। বাঁশখালীর উত্তরে শঙ্খ নদী ও আনোয়ারা, পূর্বে পাহাড় শ্রেণি ও সাতকানিয়া, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর এবং দক্ষিণে কক্সবাজারের পেকুয়া ও চকরিয়া। সমুদ্র সৈকত, ইকোপার্ক, চা বাগান ও পাহাড়ি অঞ্চলকে ঘিরে হাতছানি দিচ্ছে পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা। রয়েছে শিল্প ও কৃষি অর্থনীতির বিশাল সম্ভাবনাও।

বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য (ড. আবদুল করিম) গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘এক সময় বাঁশখালীতে অসংখ্য জমিদার ছিলেন। বখশী হামিদ ছিলেন সর্বাপেক্ষা প্রাচীন জমিদার। এছাড়াও মালেকা বানু চৌধুরানী, বনমালী মজুমদার, সাদ উদ্দিন চৌধুরী, লোচন বহদ্দার, মনু মীরজি, মুনশী জাফর আলী ছিলেন ঊনিশ শতকের জমিদার। প্রাচীনকাল, মধ্যযুগ ও ইংরেজ আমলের (ঊনিশ শতক পর্যন্ত) জমিদারদের ইলশা গ্রামের বখশী হামিদ মসজিদ, মলকা বানুর দিঘি, ১৫৬৭ সালে সুলতানী আমলের দরাফ খানের মসজিদ, হাবিবুল্লাহ মসজিদ, নবী মসজিদ, বাণীগ্রামের শিখ মন্দির, কালীপুরের কালী মন্দিরসহ অনেক নিদর্শন দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেক জমিদার স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ উন্নয়নে বড় অবদান রেখেছিলেন। অনেক জমিদারের স্মৃতি-বিজড়িত বাঁশখালীতে পর্তুগীজ ও ইংরেজদের বাঁশখালীতে আগমনের তথ্য পাওয়া যায়। তবে বাঁশখালীর নামকরণের সঠিক কোনো তথ্য মিলেনি। কিংবদন্তি রয়েছে, বাঁশখালীর পূর্ব সাতকানিয়ায় দুই ভাই ও এক বোনের পরিবার ছিল। বোনের বিয়ে হয় পাহাড়ের পশ্চিমে অর্থাৎ বাঁশখালীতে। পৈত্রিক সম্পদ নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদ-মারামারি হয়। বোনের পক্ষে প্রচুর বাঁশ ব্যবহারে বাঁশ কেটে বন উজাড় করে ফেলা হয়। বাঁশ কেটে খালি থেকে বাঁশখালী নামের উৎপত্তি বলে সমধিক জনশ্রুতি রয়েছে। (ড. আবদুল করিম)।

 

ইতিহাসসমৃদ্ধ বাঁশখালীর প্রধান সমস্যা হচ্ছে পিএবি (পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী সড়ক) সড়ক অপ্রশস্ত ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। দুই লেনের প্রধান সড়কটি ৪ লেনে উন্নীতকরণের দীর্ঘদিনের দাবি এখনো উপেক্ষিত। সরু ও দুই লেনের প্রধান সড়কটির কারণে আটকে রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা ও উন্নয়নের সুফল। বাঁশখালীর গণ্ডামারায় সাগর তীরে বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে শিল্পজোনের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই সাগর তীরে জমি কিনতে শুরু করেছেন বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তারা।

এলাকাবাসী জানান, কর্ণফুলী টানেল বাঁশখালী সড়কের সঙ্গে যুক্ত করলে বা বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দূরত্ব কমবে ৩৫ কি.মি। মহেশখালীর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, তেল সংরক্ষণাগার, অর্থনৈতিক জোনসহ বড় বড় প্রকল্প নির্মাণ করছে সরকার। যোগাযোগ ব্যবস্থা বাঁশখালীর সঙ্গে সংযুক্ত করা হলে সময় এক ঘণ্টা সাশ্রয় হবে।

 

চাষাবাদ ও হাতি আতঙ্ক : বাঁশখালী উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় চাষাবাদে বন্য হাতির তাণ্ডবে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। কয়েক বছরে হাতির আক্রমণে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। গত ৮ বছরে মারা গেছে ১৯টি হাতি। এতে পাহাড়ি চাষাবাদে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন কৃষকেরা। উপজেলার ১৪ ইউনিয়ন ও বাঁশখালী পৌরসভায় সবজি ফলন ও ধান চাষে সুনাম রয়েছে। পাহাড়ি ও সমতলে উৎপাদিত ফসল এলাকার চাহিদা মিটিয়ে ৩০ ভাগ ফসল চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি বাজারে পাঠানো হয়। ৭০ হাজার পরিবার কৃষি কাজে জড়িত বলে জানায় কৃষি বিভাগ। বাঁশখালীতে ব্যাপকভাবে লবণ চাষ হয়। এখানকার উৎপাদিত লবণ দেশে বড় চাহিদা মেটাচ্ছে।

 

জলকদর : বাঁশখালীর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জলকদর খাল। বাঁশখালীর বুকচিড়ে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত। ১৭শ শতকের প্রথম দিকে পর্তুগীজ ধর্মযাজক ও ভ্রমণকারী সেবাস্টিয়েন ম্যানরিক এই খাল দিয়ে দেয়াঙ রামু পর্যন্ত গমন করেছিলেন। এছাড়াও এই অঞ্চলের মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মিয়ানমার (বার্মা) যাতায়াত করতেন এই খাল দিয়ে। ঐতিহ্যের সেই জলকদর দখল-ভরাটে চ্যাপ্টা-ক্ষীণকায় মৃত্যুশয্যায় উপনীত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সাঙ্গু মোহনা এলাকায় দুইশ ফুট ও দক্ষিণে ২৫০ ফুট প্রশস্ত ছিল। খালটি খনন করে নৌকা-সাম্পান চলাচল উপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খালটি খনন করা হলে হাজার হাজার একর জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে। নৌ-যোগাযোগের ঐহিত্য ফিরে আসবে।

 

ইকোপার্ক : বাঁশখালী ইকোপার্ক সড়কটি ভেঙে খান খান হয়ে পড়েছে। সড়কের দুরবস্থার কারণে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন পর্যটকেরা। জীববৈচিত্র রক্ষা, ইকো ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা থাকলেও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ১৯৮৬ সালে চুনতি অভয়ারণ্য ঘোষণার পর বামের ছড়া ও ডানের ছড়া এই অভয়ারণ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

 

ফিশারি ঘাট : ফাঁড়ির মুখ ও বাংলা বাজার হচ্ছে বড় মৎস্য অবতরণকেন্দ্র। সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করে বিক্রির জন্য এখানে আনেন জেলেরা। মাছ ধরার বোট ও জেলেদের হাঁকডাকে মুখর থাকে ফাঁড়ির মুখ ও বাংলাবাজার মাছের আড়ত। পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে মাছ নিয়ে যান। তবে জেলেদের আটকে রেখে বোট ও মাছ লুটের কারণে অনেকেই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।

 

অর্থনৈতিক জোন : কর্ণফুলী নদীতে টানেল চালু হলে পাল্টে যেতে পারে এই অঞ্চলের চিত্র- এমন চিন্তাভাবনায় বাঁশখালীতে ঝুঁকছেন শিল্প-উদ্যোক্তরা। বাঁশখালীর সাগর তীরবর্তী এলাকায় জমি-জায়গা কিনতে শুরু করেছেন। সরকারি উদ্যোগে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছে অর্থনৈতিক অঞ্চল কৃর্তপক্ষ (বেজা)। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপ-সচিব আবু হেনা মো. মুস্তাফা কামাল উপকূলীয় এলাকা গণ্ডামারা পরিদর্শন করেছেন।

 

বেড়িবাঁধ : ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালীতে বেসরকারি হিসাবে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ও গবাদি পশু। বিধ্বস্ত হয়ে যায় ১৯৬০ সালে নির্মিত ভঙ্গুর বেড়িবাঁধ। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, উপকূলীয় ৩২ কিলোমিটারের মধ্যে ৯ দশমিক ৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ কাজ প্রায়শেষ। বন্যা-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় বাসিন্দাদের সুরক্ষায় পুরোটায় বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।

কুম্ভমেলা : ১৯৪৮ সালে স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ কোকদণ্ডী গ্রামে গড়ে তোলেন ঋষিধাম মন্দির। মন্দিরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে। ১৯৫৭ সালে ভারতের আদলে বাংলাদেশে একমাত্র ঋষিধামে কুম্ভমেলার প্রবর্তন করেন তিনি।

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট