চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ঘরের শত্রু যখন বিভীষণ

নগর আ. লীগ : ছয় বছরে ১৫ খুন

নাজিম মুহাম্মদ

২৩ আগস্ট, ২০১৯ | ১:৫৫ পূর্বাহ্ণ

বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলাম নয়-নগরীতে আওয়ামী লীগের শত্রু এখন আওয়ামী লীগ। যেন ঘরের শক্র বিভীষণ। গত ছয় বছরেরও কম সময়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সংগঠন নয়-নিজ নেতা ও অনুসারীদের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অন্তত ১৫ জন খুন হয়েছেন। এরমধ্যে অষ্টম শ্রেণির কিশোর যেমন আছে, তেমনি দুই পক্ষের ক্রসফায়ারে নিহতদের মধ্যে চার বছরের শিশুও রয়েছে। আছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একাধিক সাবেক নেতা। এসব হত্যাকা-ের ঘটনা ধামাচাপা দিতে সক্রিয়ও রয়েছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। ফলে এসব ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর ভবিষ্যত নিয়েও অনিশ্চয়তায় রয়েছেন নিহতদের পরিবার।

গত ১৭ আগস্ট বিকেলে নগরীর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে নগর আওয়ামীলীগ আয়োজিত শোক দিবসের আলোচনা সভায় নগর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আমি নেতাকর্মীদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, আজ যারা বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে জেলে যাচ্ছেন,সবাই আত্মঘাতী কর্মকা-ের ফলশ্রুতিতে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ কিংবা সহযোগী সংগঠনের একজন নেতাকর্মীও বিএনপি-জামায়াতের কোনো মামলার আসামি হয়ে জেলে যাচ্ছেন না।’মেয়র বলেন, ‘আমরা ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধাচরণ করছি। সংগঠনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছি। আমি আওয়ামী লীগ করি, আপনিও আওয়ামী লীগ করেন। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করি, আপনিও করেন। অথচ আমরা ব্যক্তিস্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছি। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

গত ছয় বছরেরও কম সময়ে সংঘটিত এসব হত্যাকা-ের মধ্যে আলোচিত হলো চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস, গণপিটুনির নামে নিহত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক উপ-পাঠাগার সম্পাদক মহিউদ্দিন সোহেল, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী, মহানগর যুবলীগ নেতা মেহেদী হাসান বাদল, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপ-অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর বাবর ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ- সম্পাদক সাইফুল আলম লিমন গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে যুবলীগ নেতা সাজু পালিত ও পথশিশু আরমান খুনের ঘটনা দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছে। ২০১৫ সালের মেয়র নির্বাচনের কিছুদিন পর খুন হন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী যুবলীগ নেতা। এর জন্য দায়ী করা হয় মেহেদীর দুই বন্ধু শফিকুর রহমান ও আবদুল কুদ্দুসকে।
এর বাইরে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়াকে কেন্দ্র করে লালখান বাজার এলাকার হাইলেভেল রোডে যুবলীগ কর্মী মো. শরীফ ওরফে টেম্পু শরীফ, লালখান বাজার পোড়া কলোনি এলাকায় যুবলীগ কর্মী খোকন সরকার, একই এলাকার ছাত্রলীগ কর্মী দিদারুল আলম, বাগমনিরাম ওয়ার্ডে যুবলীগ কর্মী অনিক, সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় যুবলীগ কর্মী মহিউদ্দিন খুন হন দলীয় নেতাদের নির্দেশেই। প্রতিটি ঘটনায় দলীয় নেতাদেরই আসামি করে মামলা করা হয়েছে।
এরমধ্যে সুদীপ্ত হত্যা মামলার নির্দেশদাতা হিসেবে নাম আসা লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম বর্তমানে কারাগারে আছেন। একই এলাকার ছাত্রলীগ কর্মী দিদার খুনের ঘটনায় প্রধান আসামি নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য আবুল হাসনাত বেলাল। রেলওয়ে সিআরবিতে জোড়া খুনের ঘটনায় কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর বাবর ও কেন্দ্রীয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমনের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে। নগরীর পাহাড়তলী বাজারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক উপ-পাঠাগার সম্পাদক মহিউদ্দিন সোহেলকে খুনের ঘটনায় সরাইপাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহবায়ক সাবের আহমদ সওদাগর বর্তমানে কারাগারে আছেন। অভিযোগ রয়েছে,গণপিটুনির নামে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সহযোগিতায় সাবের সওদাগর খুন করেন মহিউদ্দিন সোহেলকে। এরমধ্যে সাবের সওদাগর নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীনের অনুসারী। আর নিহত সোহেল চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় যুবলীগ কর্মী মহিউদ্দিন হত্যা মামলার প্রধান আসামি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজি ইকবাল উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে সম্প্রতি বের হয়েছেন। বাগমনিরাম ওয়ার্ডে গত বছর ঈদের দিন খুন হন যুবলীগ কর্মী অনিক। তিনি আ জ ম নাছিরের অনুসারী। তার হত্যাকারীরা মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী বলে পরিচিত।

নগরীর চকবাজার এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবদুর রউফ গঠন করেন কিশোর গ্যাং। তাদের হামলায় একবছর আগে জামাল খান ওয়ার্ডের ডা. খাস্তগীর স্কুলের সামনে খুন হয় কলেজিয়েট হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র প্রকৌশলী দম্পতির একমাত্র ছেলে আদনান ইসফার। সে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত নুরুল আলম চৌধুরী নাতি।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু বলেন, মাঠে সত্যিকার রাজনীতি না থাকায় এ ধরনের ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। প্রকৃত রাজনীতি থাকলে নেতাকর্মীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে। নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন থাকতো। নেতৃত্বেও প্রতিযোগিতা থাকতো। রাজনীতি ফড়িয়াদের হাতে চলে গেলে যা হয়, এখন ঠিক তা-ই হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, চট্টগ্রামে বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আদর্শের চেয়ে ব্যক্তির স্থান বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রথা চালু রয়েছে। ফলে এখানে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনীতির মাধ্যমে বিরোধী দলকে ঠেকানোর উদ্যোগ নেই। এ অবস্থায় রাজনীতির মাঠে নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে চলেছে। তাঁরা বলেন, দলের বৃহৎ ঐক্য তৈরি না হলে আগামীতেও এ ধরণের ঘটনা ঘটতে থাকবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট