চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দুবাইয়ে মূল হোতা, প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে সহযোগীরা

ইমাম হোসাইন রাজু

২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ | ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ

নগরীর চান্দগাঁওয়ের শমসের পাড়ার গ্লোরি মাল্টিপারপাস সমিতির টাকা আত্মসাতের ঘটনার সত্যতা খুঁজে পেয়েছে সমবায় অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটি। অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মূলহোতা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ঈসাসহ কমিটির ছয় সদস্যকে দায়ী করা হয়। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গত ৩০ নভেম্বর সমবায় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। এদিকে, টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় গ্রাহকদের ব্যাপক বিক্ষোভের পরও আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় নির্বিঘ্নে দুবাইয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন মূলহোতা মোহাম্মদ ঈসা।

 

 

অন্যদিকে, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ অবস্থায় টাকা উদ্ধার করে গ্রাহকের হাতে তুলে দেয়াটা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও, সমবায় অধিদপ্তরের দাবি শীঘ্রই এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

 

এর আগে ২০২২ সালের ১৯ জুলাই দৈনিক পূর্বকোণে ‘৮ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা আ. লীগ নেতা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের পরপরই তদন্তে নামে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান জেলা সমবায় দপ্তর। এরমধ্যে সদ্য বিদায়ী বছরের ৩০ নভেম্বর এ সংক্রান্ত বিষয়ে পাঁচ পাতার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন গঠিত কমিটি।

 

 

জানা যায়, ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করে গ্লোরি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। যা ২০০৭ সালের ৯ মে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন গ্রহণ করে। এরমধ্যে গেল বছরের মাঝামাঝিতে সমিতির সকল সঞ্চয় হাতিয়ে গা ঢাকা দেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ঈসা। যিনি চান্দগাঁও বি ইউনিটের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। গা ঢাকার দেয়ার পর ঈসার খোঁজে বিজ্ঞপ্তিসহ নানা প্রচার প্রচারণা চালালেও তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি।

 

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, সমিতির টাকা আত্মসাতের ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আত্মগোপনে চলে যায় মোহাম্মদ ঈসা। সংবাদ প্রকাশের মাসখানেক পর নগরীর পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিস থেকে নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন তিনি। আগস্ট মাসে পাওয়া নতুন পাসপোর্ট (পাসপোর্ট নম্বর-০৭৪৮২৪২) গ্রহণের পরই ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা এয়ারপোর্ট হয়ে এমিরেটস এয়ারলাইন্স যোগে দুবাই পাড়ি দেন তিনি। বর্তমানে তিনি দুবাইয়ে অবস্থান করছেন।

 

 

দায়ী কমিটির সদস্যরাও : পাঁচ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ঈসা সমিতির সার্বিক কর্মকাণ্ডের সিংহভাগ পরিচালনা করে প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন কুট কৌশলে অর্থ আত্মসাৎ করেন। সমিতির সভাপতি মো. আজম খান ও ব্যবস্থাপনা কমিটির অন্যান্য কর্মকর্তাগণ সমিতির আর্থিক কর্মকাণ্ডের সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। যদিও সমিতির সকল কর্মকাণ্ডের সাথে সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ঈসা সরাসরি জড়িত থাকলেও ব্যবস্থাপনা কমিটির বাকি কর্মকর্তারাও দায় এড়াতে পারেন না। বরং উক্ত মামলার মূল অভিযোগের সাথে তারা সম্পৃক্ত এবং সকল প্রকার লেনদেনের জন্য দায়ী।

 

 

তাদের জ্ঞাতসারে সম্পাদক মোহাম্মদ ঈসা প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন জালজালিয়াতি করে সমিতির সকল কর্মকাণ্ড ও লেনদেন এককভাবে পরিচালনা করতেন। ফলশ্রুতিতে অর্থ আত্মসাৎ করে তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। সুতরাং প্রতারিত সদস্যদের সঞ্চয় আমানতের অর্থ ব্যবস্থাপনা কমিটি সকল কর্মকর্তার নিকট হতে আদায়যোগ্য বলে মন্তব্য করেন তদন্ত কমিটি। এ বিষয়ে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎ এবং আত্মসাৎকৃত অর্থ আদায়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করেন কমিটি।

 

 

তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম জেলা সমবায় অফিসার মুরাদ আহম্মেদ পূর্বকোণকে বলেন, ‘ঘটনা নজরে আসার পরপরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে মামলাও দায়ের করা হবে। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’

 

 

কাগজে মিলল সাড়ে পাঁচ কোটি : তদন্তে কমিটি ও প্রতারিত সদস্যদের দালিলিক কাগজপত্র অনুসারে সর্বমোট ৫ কোটি ২৯ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৮ টাকা সমিতির তহবিলে সঞ্চয় হিসেবে আমানত ছিল বলে পাওয়া যায়। এরমধ্যে ৩৯ জন সদস্যের দৈনিক সঞ্চয় ছিল ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৫৭০ টাকা। ৬৩ জন সদস্যের সাপ্তাহিক সঞ্চয় ছিল ১১ লাখ ৯১ হাজার ২৬ টাকা, ১৬৭ জন সদস্যের মাসিক সঞ্চয় ছিল ৬৪ লাখ ৪৬ হাজার ৭৮২ টাকা এবং এফডিআর আ মেয়াদি সঞ্চয় হিসেবে ৪ কোটি ৪৬ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ টাকা ছিল। যদিও এসব অর্থের মধ্যে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও অর্থ সম্পাদকের স্বাক্ষরে ৩৬ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা গৃহীত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেলেও বাকি ৪ কোটি ৯২ লাখ ৮৪ হাজার ৩৭৮ টাকাই গ্রহণ করা হয় সম্পাদক মোহাম্মদ ঈসার স্বাক্ষরে।

 

 

লেখা হয়নি প্রকৃত হিসাব : কাগজে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার হিসেব পাওয়া গেলেও এরবাইরেও আরও অর্থ থাকতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। সঞ্চয়কৃত অর্থ গ্রহণ করা হলেও তা নিয়মিত লেজার বুক কিংবা কোথাও লিপিবদ্ধ করা হয়নি বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে ওঠে আসে। এমন কথাও স্বীকার করেন খোদ কমিটির সভাপতি-অর্থ সম্পাদকসহ অন্যরাও।

 

 

তদন্ত কমিটির কাছে সভাপতি মো. আজম খান অর্থ সম্পাদক ওসমান গনি এবং সদস্য এন এম হাসান মুরাদসহ চারজনের বক্তব্যে সমিতির লেজার বুক, ক্যাশ বুক ব্যবহার না করে একটি সফটওয়ার ব্যবহার করা হতো এবং উক্ত সফটওয়ারে সকল হিসাব ঠিক করে লিপিবদ্ধ বা এন্ট্রি দেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করেন। সে হিসেবে উল্লেখিত অর্থের বাইরেও আর কত টাকা ছিল তার কোন হদিস নেই।

পূর্বকোণ/আরএ

 

 

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট