চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘চলরে মন ত্বরাই যাই বিলম্বের আর সময় নাই’

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৪ জানুয়ারি, ২০২৩ | ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ

‘চলরে মন ত্বরাই যাই, বিলম্বের আর সময় নাই/ গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারী স্কুল খুলেছে’/ ‘দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে হইতেছে নুরের খেলা’/ ‘আমার গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারী আয়নার কারিগর’/ মাইজভাণ্ডারী বাবা আমার নূরের পুতুলা/ আমার প্রাণে খোঁজে মাইজভাণ্ডার/ ‘বিচ্ছেদের অনলে সদা অঙ্গ জ্বলে’/ ‘আমি আমারে বেইচা দিছি মাইজভাণ্ডারে যাইরে’- মাইজভাণ্ডারী তরিকার মাহাত্ম্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক আবহমণ্ডিত গানের তালে তালে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে আশেক-ভক্তরা দলে দলে ছুটছেন মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে। প্রতিবছর এই দিনে ফটিকছড়ি মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে লাখো মানুষের মিলনমেলা ঘটে।

 

 

১৯০৬ সনে ২৩ জানুয়ারি, ১০ মাঘ উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলিয়ে কামেল মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রবর্তক হযরত শাহসুফি মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ (ক.) মাইজভাণ্ডারী ইহজগৎ-ধরাধাম ত্যাগ করেন। ১১৭ বছর ধরে ১০ মাঘ মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রাণপুরুষের স্মরণে ওফাত বার্ষিকী পালন করে আসছেন ভক্ত-অনুরক্তরা।

 

 

দেশ-বিদেশ থেকে লাখো ভক্ত-অনুরক্ত, মুরিদান-আশেকান জাতি-ধর্ম-ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে শরিক হন ওরশ শরিফে। লাখো মানুষের মিলনমেলা ঘটে ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার গ্রামে। লাখো ভক্ত-আশেকানের উপস্থিতিতে মুখর হয়ে উঠে মাইজভাণ্ডার শরিফ। ওরশ শরিফ উপলক্ষে হযরত আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভাণ্ডারী কেবলার মাজারসহ মাইজভাণ্ডার শরিফের রওজা-মাজার ও স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠেছে। বর্ণিল সাজে সেজেছে মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ।

 

 

ওরশ উপলক্ষে মাইজভাণ্ডারে বসেছে গ্রামীণ লোকজ মেলা। মেলায় মুড়ি-মুড়কি ও মণ্ডা-মিঠাই থেকে গৃহস্থালি লোকজ সামগ্রী-পসরা সাজিয়ে বসেছে হাজারো দোকান। রয়েছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের নাগরদোলা, খেলনাসহ আরও কত কী। সপ্তাহব্যাপী চলে এ লোকজ মেলা, বিকিকিনি।

 

 

চট্টগ্রাম শহর থেকে উত্তরে ২৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মাইজভাণ্ডার শরিফ। ওরশ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্ত-অনুরক্ত ও আশেকানরা কয়েক দিন আগ থেকেই দরবার শরিফে পৌঁছেন। ইবাদত-বন্দেগী, জেয়ারত, দোয়া মাহফিল, জিকির-আশকারে মশগুল থাকেন তাঁরা। দয়াময় স্রষ্টার কাছে নিজেদের সমর্পণ ও বিশ্ব মানবতার শান্তি-কল্যাণ কামনায় মোনাজাত করা হয়।দরবার-মনজিলে দলে দলে চলে ভাণ্ডারী তরিকার ছেমা মাহফিল ও মাইজভাণ্ডারী তরিকার আধ্যাত্মিক গান। এসব গানে গানে মাইজভাণ্ডারী তরিকার আধ্যাত্ম্য-বাণী, শান-মান-অলৈকিকতা ও মাইজভাণ্ডারী ইতিহাস-ঐতিহ্য ফুটে ওঠে ছেমা-গানে।

 

 

সংক্ষিপ্ত জীবনী : হযরত রাসুল করিম (দ.) এর পবিত্র বংশধর গৌড় নগরের বিচারপতি হযরত শাহ্সূফি সৈয়দ হামিদ উদ্দিন গৌড়ি (র.) (১৫৫০-১৬৪৮) ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ঐশী নির্দেশে চট্টগ্রামের পটিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। তাঁর বংশধর দরবেশ হযরত শাহ্সুফি সৈয়দ মতিউল্লাহ (র.) মাইজভাণ্ডারে আবাস গড়ে তোলেন। ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর কৃপাধন্য হন তিনি। তাঁর তিন সন্তান গাউসুল আজম হযরত শাহ্সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.), দ্বিতীয় পুত্র হযরত শাহ্সুফি সৈয়দ আবদুল হামিদ (র.), তৃতীয় পুত্র হযরত শাহসুফি সৈয়দ আবদুল করিম (র.)।

 

 

আহমদ উল্লাহ ১৮২৬ সালে ১৪ জানুয়ারি (১লা মাঘ, ১২৩৩ বাংলা সন) মাইজভাণ্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ মতিউল্লাহ মাইজভাণ্ডারী ও মাতার নাম সৈয়দা খায়রুন্নেছা। জন্মের পর পরই ধর্মীয় শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এরপর কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা হতে কোরআন, হাদিস, তফসির, ফেকাহসহ বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শেষে ১২৬৯ হিজরি দেশে ফিরে আসেন। যশোরের বিচার বিভাগে কাজীর পদে নিয়োজিত হন। পরের বছর স্বেচ্ছায় কাজীর পদ থেকে পদত্যাগ করে কলিকাতার বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুন্সী বু’আলী ও আলিয়া মাদ্রাসায় প্রধান মোদারেস হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।

 

 

এই সময়ে পীরানে পীর দস্তগীর মাহবুবে সোবহানী গাউসুল আজম মহিউদ্দিন শেখ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী (ক.)-এর বংশধর ও খলিফা সৈয়দ আবু শাহামা মোহাম্মদ সালেহ আল-কাদেরী লাহোরী (ক.)-এর দস্তে বায়াত গ্রহণ করে আধ্যাত্ম সাধনায় নিয়োজিত হন। পীরের নির্দেশে হযরত আবু শাহামা (ক.)-এর অগ্রজ শাহসুফি সৈয়দ দেলওয়ার আলী পাকবাজ- মোজাহেরে মদনীর সোহবতে কুতবিয়তের ফয়জ হাসিল করেন। পাঁচ বছর পীরের সান্নিধ্যে থেকে ১২৭৫ হিজরি সনে মাইজভাণ্ডারে ফিরে এসে আস্তানা স্থাপন করেন। অর্জিত বেলায়তী ক্ষমতার দীপ্তি বিকশিত হতে থাকে। তরঙ্গের অভিঘাতের মতো তা স্পর্শ করে থাকে মানুষের হৃদয়কে।

 

 

তাঁর আধ্যাত্মবাদ ও ঐশীপ্রেমের সাধনাকেন্দ্র মাইজভাণ্ডার শরিফ গড়ে ওঠে। স্রষ্টার নৈকট সাধনায় ‘উসুলে সাবআ’ বা সপ্ত পদ্ধতির অনুশীলন প্রক্রিয়ার সহযোগে তিনি মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকার সূচনা করেন। দ্বীনি শিক্ষাদান, এবাদত, রেয়াজত ও কঠোর সাধনার ফলে তিনি আধ্যাত্মিক জগতের সর্বোচ্চ বেলায়ত অর্জন করেছিলেন। ৭৯ বছর বয়সে ১৯০৬ সনে ২৩ জানুয়ারি ২৭ জিলকদ ১০ মাঘ ভক্ত অনুরক্তদের ছেড়ে ধরাধাম ত্যাগ করেন। প্রতিবছর এদিনে প্রধান ওরফ শরিফ মহাসমারোহে পালন করা হয় মাইজভাণ্ডার শরিফে।

পূর্বকোণ/আরএ

 

 

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট