চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অনন্য কর্ণধার আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু

বোরহানউদ্দিন চৌধুরী মুরাদ

৪ নভেম্বর, ২০২২ | ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ

জীবনে অনেকবার মন্ত্রীত্বের সুযোগ পেয়েও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিচক্ষণ রাজনীতির ধারক ছিলেন। চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক উজ্জল জ্যোতিষ্ক। তিনি চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের এক অনন্য কর্ণধার। তিনি ছিলেন একজন রাজকীয় এবং বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিতে যেমন ব্যবসা, ব্যাংক, বীমা ও শিল্প স্থাপনে তিনি ছিলেন একজন ঈর্ষণীয় সফল ব্যক্তিত্ব। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) অর্জন করেছেন।

 

সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নানা ঝামেলার মাঝেও দলীয় আদর্শে ছিলেন দৃঢ়। দলীয় নেতা-কর্মীদের নিকট হয়ে উঠেছিলেন বড় অবলম্বন। রাজনীতিসহ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। দেশের বেকারত্ব হ্রাসে সহায়তা করেছেন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বহু বছর ধরে সক্রিয় ছিলেন। তিনি দীর্ঘ একটি সময় ধরে দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন। আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে চার বার নির্বাচিত হয়েছেন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি পাট বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন।

 

 

১৯৪৫ সালে হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুলী বাবু। তার পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন একজন আইনজীবী এবং জমিদার। তার মাতার নাম খোরশেদা বেগম। তিনি স্বনামধন্য শিল্পপতি বোয়ালখালীর উপজেলার আলহাজ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা নুর নাহার জামান এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। একই বছরে ঢাকা নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। এরপর তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজসেন এডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে এসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরেন।

 

১৯৬৫ সালে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি মূল সংগঠন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হন। তিনি ছিলেন ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।

 

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় সংগ্রাম কমিটির কর্মকান্ড পরিচালিত হত তাঁর পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউজ থেকে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইকোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।

 

মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান, সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণে ভূমিকা রাখেন। পরে ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন স্বাধীনতার পর। তিনি বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

 

১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু খুন হবার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং দলের পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তিনি বলিষ্ট ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারানির্যাতন ভোগ করেন। রাজনীতিবিদসহ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পদ্যোক্তা ছিলেন।

 

স্বাধীনতার আগে তিনি বাটালি রোডে বয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যানাম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট ক্রয় তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরমিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। তিনি বাংলাদেশ বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশের দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) এর উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি ২০১১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে পুননির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।

 

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র ও ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দু’দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশী যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি একজন সমাজহিতৈষী, দানবীর ও জনদরদী ছিলেন।

 

১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইলধর ইউনিয়নর পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার পরেও তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং থানা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। আনোয়ারা ডিগ্রী কলেজ, যোগেশ চন্দ্র মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, হাইলধর বীশরুজ্জামান উচ্চবিদ্যালয়, বরুমচড়া, বশরুজ্জামান উচ্চবিদ্যালয় ও ঝিবাশি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাসহ বটতলী মোহছেন আউলিয়া ডিগ্রী কলেজ, চন্দনাইশ বরমা কলেজ, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ, এ.জে. চৌধুরী ডিগ্রী কলেজ, রায়পুর উপকূলীয় উচ্চবিদ্যালয়সহ আনোয়ারা পশ্চিম পটিয়ার ও চট্টগ্রামে অনেক স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদাতা সদস্য। এছাড়াও বহু জনহিতকর কাজের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি।

 

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মত এত বড় মাপের মহৎ হৃদয়বান জাতীয় নেতার সহচার্য লাভের যার সুযোগ হয়েছে, সেই সৌভাগ্যবান। বিশ্বস্ততার সহিত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা যারা তার অভিভাবকত্বে তার সাথে রাষ্ট্রের সেবামূলক কাজ করেছি এবং তার সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। তাকে কাছ দেখেছি, মিশেছি। সুখ, দুঃখের সঙ্গী হয়েছি। আমরা দেখেছি, তার মধ্যে এক নরম প্রকৃতির হৃদয়, মানুষকে ভালবাসার উদার মন-মানসিকতা।

 

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সমস্ত লোভ-লালসার উর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে নির্মাণের সম্মুখসৈনিক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর কালের সেই সব বিরল রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম, যারা আওয়ামীলীগের দুঃসময়ে হাল ধরেছেন, রাজনীতি করেছেন নিজের অর্থ ব্যয় করে, বর্ষিয়ান এই আওয়ামীলীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন এমনি এক অসাধারণ মহাপুরুষ। যার সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে বিশাল এক প্রাণবন্ত জগত।

 

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে তাঁর অবদান অপরিসীম। যে কোন কঠিন সময়ে দলের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত এক কর্মী। ছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের একজন অভিভাবক। তার মৃত্যুতে চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগকে শুধু অভিভাবকহীন করেনি, সামগ্রিক রাজনীতিতে একটি শূন্যতার সৃষ্টি করেছে।

 

পূর্বকোণ/আর

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট