চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

মর্গের ভাড়া এসেছে সোয়া কোটি টাকা

১০ বছর ধরে চমেক মর্গে ৪ রোহিঙ্গার লাশ

নাজিম মুহাম্মদ

২১ অক্টোবর, ২০২২ | ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

চার রোহিঙ্গা শরণার্থীর মৃতদেহ নিয়ে বিপাকে পুলিশ। দুইজনের মৃতদেহ ১০ বছর একজনের আট বছর এবং একজনের মৃতদেহ পাঁচ বছর ধরে সংরক্ষিত রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক) মর্গের ডিপফ্রিজে। চার শরণার্থীর মৃতদেহ সংরক্ষণে বকেয়া জমেছে এক কোটি ২৪ লাখ টাকার বেশি। বকেয়া টাকা পরিশোধ করে মৃতদেহগুলো নিয়ে যাবার অনুরোধ জানিয়ে গত ১০ অক্টোবর চমেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ থেকে নগর পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

 

ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সুমন মুৎসুদ্দি স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে দুটি, ২০১৪ সালে একটি ও ২০১৭ সালের একটিসহ মোট চারজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর মৃতদেহ দীর্ঘদিন ধরে চমেক হাসপাতালের মর্গে সংরক্ষিত আছে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ায় বর্তমানে মৃতদেহগুলো আকৃতিগতভাবে নষ্ট হওয়ার শেষ পর্যায়ে। আপনাকে অনুরোধ করা যাচ্ছে চারটি মৃতদেহ যত দ্রুত সম্ভব গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে জটিতলা নিরসন করা একান্ত প্রয়োজন।

 

বকেয়া কোটি টাকা : ২০১২ সালের ২৬ অক্টোবর চমেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ থেকে বকেয়া পাওনা চেয়ে পাঁচলাইশ থানার ওসির কাছে প্রথম চিঠি দেয়া হয়। সেই সময় দুই লাশের ডিপফ্রিজ ভাড়া বকেয়া ছিল এক লাখ ৪২ হাজার টাকা। চিঠিতে বলা হয়েছে দুটি লাশের প্রতিদিন ডিপফ্রিজ ভাড়া দুই হাজার টাকা বাড়বে।

 

এরমধ্যে ডিপফ্রিজে জমা হয়েছে আরো দুই রোহিঙ্গার মৃতদেহ। যেমন ২০১২ সালের ১৭ জুন থেকে মর্গের ডিপফ্রিজে সংরক্ষিত আছে রোহিঙ্গা কালা হোসেন ও তৈয়বের মৃতদেহ। দশ বছরের অধিক সময়ে দুই মৃতদেহের ডিপফ্রিজ ভাড়া বকেয়া পড়েছে প্রায় ৭৫ লাখ। একইভাবে ২০১৪ সাল থেকে ৮ বছরে সহিমং থো লাশের প্রায় ৩০ লাখ এবং ২০১৭ সাল থেকে ডিপফ্রিজে থাকা রোহিঙ্গা হাফেজ সিরাজের লাশের ভাড়া বকেয়া পড়েছে ১৮ লাখ ২৫০ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে চার লাশের ডিপফ্রিজ ভাড়া বকেয়া পড়েছে প্রায় এক কোটি ২৪ লাখ টাকা।

 

পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (ওসি) নাজিম উদ্দিন মজুমদার জানান, নিয়ম অনুযায়ী মৃতদেহগুলো আমরা পাঁচলাইশ থানা পুলিশ ময়নাতদন্ত করেছি। কোন স্বজন না থাকায় মৃতদেহগুলো মর্গের ডিপফ্রিজে রাখা হয়েছে। ফরেনসিক বিভাগ ফ্রিজের ভাড়া চেয়ে চিঠি দিলে বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ চার রোহিঙ্গা তাদের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি না দেয়ায় দেশের প্রচলিত আইন ও ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী মৃতদেহগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমরা চেয়েছিলাম লাশগুলো আনজুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করতে। কিন্তু মেডিকেল কর্তৃপক্ষ বকেয়া টাকা ছাড়া লাশ দিতে রাজী নন। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

 

ডিপফ্রিজে ৪ লাশ : ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মিয়ানমারে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় রোহিঙ্গা নাগরিক আবু তৈয়ব (২০) ও কালা হোসেন (৫০) নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। অবৈধ অনুপ্রবেশের অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় মামলা হয়। জরুরি চিকিৎসা নিতে তাদের চমেক পাঠায় কক্সবাজার মডেল থানা পুলিশ। চমেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১২ সালের ১৭ জুন আবু তৈয়ব ও ১২ জুন কালা হোসেন মারা যায়।

নিয়ম অনুযায়ী পাঁচলাইশ থানা পুলিশ দুইজনের মৃতদেহ সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করেন। ময়নাতদন্তের পর প্রায় সাড়ে দশ বছর ধরে দুইজনের মৃতদেহ চমেক হাসপতাল মর্গের ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষিত রয়েছে। এরপর থেকে দুই লাশের খবর নেয়নি কেউ।

এদিকে ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট ডিপফ্রিজে দুই রোহিঙ্গার মৃতদেহ সংরক্ষণ বাবদ এক লাখ ৪২ হাজার টাকা বিল দাবি করে পাঁচলাইশ থানার ওসির কাছে একটি চিঠি পাঠায় চমেক হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ।

 

ফরেনসিক বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, দুটি মৃতদেহ ডিপফ্রিজে সংরক্ষণ বাবদ প্রতিদিন দুই হাজার টাকা করে বকেয়া বিল বাড়ছে। এরপর থেকে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ, চমেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ, কক্সবাজার মডেল থানা, নগর বিশেষ শাখার মধ্যে চিঠি চালাচালি হয় দফায় দফায়। বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে বাংলাদেশস্থ মিয়ানমার দূতাবাস পর্যন্ত গড়ায়। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দুইজনের বিরুদ্ধে কক্সবাজার ও টেকনাফ থানায় মামলা রয়েছে।

 

২০১২ সালের ২৬ জুলাই নগর পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে একটি চিঠি পাঠানো হয় কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে। বিশেষ শাখার পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা নাগরিক আবু তৈয়ব ও কালা হোসেন চিকিৎসাধীন অবস্থায় চমেক হাসপাতালে মারা যায়।
দুইজনের মৃতদেহ মিয়ানমারে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে ঢাকাস্থ মিয়ানমার দূতবাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিঠি পাঠানো হয়।

 

উত্তরে মিয়ানমার দূতাবাস জানান, নিহতরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। কারণ তাদের কাছে মিয়ানমারের জাতীয় পরিচয়পত্র, রেজিস্ট্রেশন কার্ড নেই। তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রচলিত বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে মিয়ানমার দূতাবাস।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট