চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

আড্ডা থেকে অপরাধে কিশোর দল

চিহ্নিত আড্ডাস্থল নজরদারি কাগজে কলমে

নাজিম মুহাম্মদ

১৫ আগস্ট, ২০১৯ | ১:৩৫ পূর্বাহ্ণ

আকবরশাহ থানার পূর্ব ফিরোজশাহ ফরেস্ট হিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির একজন ছাত্রীকে গত ১২ আগস্ট দুপুরে উত্যক্ত করে কিশোরের দল। বোনকে উত্যক্ত করায় প্রতিবাদ করে বড় ভাই সোহেল। এতে আরো বেশি ক্ষেপে যায় কিশোরের দল। ওইদিনই বিকেল সাড়ে চারটার সময় পরিকল্পিতভাবে আট কিশোর দল বেধে এসে বাসার সামনে সোহেলকে বেধড়ক মারধর করে। এক পর্যায়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হৃদয় (১৬) ও ইব্রাহিম (১৭) তাকে ছুরিকাঘাত করে। আহত সোহেলের চিৎকারে আশেপাশের লোকজন ছুটে এসে কিশোর গ্যাং গ্রুপের একজনকে আটক করে। সংবাদ পেয়ে পুলিশ এসে আরো এক কিশোরকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পরবর্তীতে আরো দুই কিশোরসহ মোট চারজনকে আটক করে আকবরশাহ থানা পুলিশ।
আকবরশাহ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বিকাশ সরকার জানান, এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আটজনকে এজাহারভুক্ত আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার দিন আমরা প্রথমে দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছি। গতকাল বুধবার সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে আরো দুই কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার চার কিশোর হলেন, পূর্ব ফিরোজশাহ বিহারী ক্যাম্পের জুয়েল ওরফে সুমিত হোসেন (১৬), হাসান ওরফে রিংকু (১৬), হৃদয় (১৬) ও ইব্রাহিম হোসেন ইমন (১৭)। গত ৩০ জুন বিশ্বকলোনি এলাকায় মহসিন (২৬) নামে এক যুবলীগ কর্মীকে কথিত বড় ভাইয়ের নির্দেশে মধ্যযুগীয় কায়দায় পিটিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের সকলের বয়স ১৭ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। গত ১০ জুলাই হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের ছাত্র জিয়াউল হক নয়নকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতে গিয়ে আবিদ ওয়াসিফ ও

নুর হোসেন নামে দুই কিশোরকে গ্রেপ্তার করে খুলশী থানা পুলিশ। নগর পুলিশের পশ্চিম জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) ফারুকুল হক বলেন, কিশোর অপরাধ বন্ধ করতে পারিবারিক অনুশাসন খুবই জরুরি। নানা অপরাধে জড়ানোর অপরাধে অনেক কিশোরকে ধরে থানায় নিয়ে আসার পর অভিভাবকের হাতে তুলে দিয়েছি। মামলায় আসামি করা হলে কিশোরের মনে নেতিবাচক ধারণা জন্মায়।
ডিসি বলেন, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সাধারণ বিভিন্ন ইস্যুতে ছাত্র আন্দোলন করে। ছাত্র আন্দোলন সব সময় ছিল। আগে স্কুল পড়–য়া ছাত্রদের সাধারণত আন্দোলনে কিংবা মিছিল মিটিংয়ে দেখা যেত না। বর্তমানে কথায় কথায় কিশোর বয়সী ছাত্ররা রাস্তায় নেমে পড়ে। স্কুলের শিক্ষকরা বিষয়টি নজরদারিতে রাখলে কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা আরো কমে যেতো।
নজরদারি নেই কিশোরদের আড্ডাস্থল। কিশোর আড্ডা থেকে ঘটছে খুনের ঘটনাসহ নানা অপরাধ। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি নগরীর জামাল খানে আরেক আদনান খুন হয় গ্যাং গ্রুপের হাতে। আদনান খুনের পর নগর পুলিশের উত্তর ও দক্ষিণ জোনের আট থানায় চিহ্নিত করা হয়েছিল ১৭৩ কিশোরদের আড্ডাস্থল। কয়দিন নজরদারি রাখার পর তা আর অব্যাহত থাকেনি। আদনান খুনের এক বছর চার মাসের মাথায় ফের কিশোরের গুলিতে গত ৬ এপ্রিল খুন হয় কিশোর ‘গ্যাং গ্রুপের’ নেতা লোকমান হোসেন রনি। লোকমানের নেতৃত্বে একদল কিশোর নগরীর গোলাপাহাড় এলাকায় নিয়মিত আড্ডা দিতো। নিজের গ্রুপের এক কিশোরের প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাকলিয়া খালপাড় এলাকায় আরেক কিশোর গ্রুপের সদস্যের উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে খুন হন লোকমান। এ ঘটনায় পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় বাকলিয়া খালপাড় এলাকার কিশোর গ্রুপের আরেক বড় ভাই সাইফুল।
অনুসন্ধানে জানাযায়, হাতেগোনা কয়েকটি আড্ডারস্থান ছাড়া বাকিগুলোতে মাদক সেবন, মাদক ব্যবসা, কিশোর ও উঠতি বয়সী যুবকদের নিয়ে বড় ভাইদের আড্ডা, স্কুল কলেজগামী ছাত্রীদের ইভটিজিং, রাজনৈতিক গ্রুপিং এবং এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারি আর খুনের ঘটনা সৃষ্টি হচ্ছে।
লোকমান হোসেন রনি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত গ্রেপ্তার জিয়াউদ্দিন বাবলু আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, সদ্য কৈশোর পার হওয়া দুই তরুণের প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুন হয় লোকমান। নগরীর গোলপাহাড় এলাকায় নিয়মিত আড্ডা দিতো কিশোর জয় ও অনিকদের একটি গ্রুপ। আর এ কিশোর গ্রুপের নেতৃত্ব দিতো লোকমান। খালপাড় এলাকার বড় ভাই সাইফুলের নিয়ন্ত্রণেও কয়েকটি কিশোর গ্রুপ রয়েছে। সাইফুলের অনুসারী কিশোর ছোটন লোকমানের মাথা লক্ষ্য করে প্রথমে গুলি করেছিল।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, মূলত রাজনৈতিক সমর্থন, বিপুল অর্থপ্রাপ্তি এবং এলাকায় প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে কিশোররা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রাজনীতির খোলসে কথিত বড় ভাই কিশোরদের হাতে তুলে দিচ্ছে ভয়ংকর অস্ত্র।
২০১৮ সালের কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান খুনের ঘটনার পর কিশোর আড্ডাস্থলে নজরদারি বাড়িয়েছিল নগর পুলিশ। নগর পুলিশের উত্তর ও দক্ষিণ জোনের আট থানায় কিশোরদের ১৭৮টি আড্ডাস্থল চিহ্নিত করেছিল পুলিশ। এরমধ্যে উত্তর জোনের খুলশী থানায় ৩৪টি, পাঁচলাইশ থানা এলাকায় ৩৩টি, চান্দগাঁও থানায় ২৩টি, বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় ১৫টি ও দক্ষিণ জোনের চার থানার মধ্যে কোতোয়ালিতে ৩২, বাকলিয়া থানা এলাকায় ৫টি, চকবাজার থানায় ১৪টি ও সদরঘাট থানায় ২২টিসহ মোট ১৭৮ টি আড্ডার স্থান চিহ্নিত করা হয়েছিল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট