চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

টেলিফোন নয়, টাকার মেশিন

নাজিম মুহাম্মদ

৬ অক্টোবর, ২০২২ | ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

টেলিফোন নয় যেন টাকা তৈরির মেশিন। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে ফোনের অবস্থান। এ ফোনে কথা বলতে প্রতি মিনিটে বন্দীদের দিতে হয় কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী একজন বন্দী স্বজনের সাথে ফোনে ১০ মিনিট কথা বলতে পারেন। আর ১০ মিনিটে বন্দীদের গুনতে হয় ৫ থেকে ৬ শ টাকা। কারাগারের জেলার, জমাদার, সুবেদার, কারারক্ষী- সবাই মিলে এ টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

বন্দীদের মুঠোফোনে কথা বলার সুবিধা না থাকায় কারাগারের এ টেলিফোন যেন দুর্লভ বস্তু। গত তিনদিনে কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে আসা অন্তত দশ জন বন্দীর সাথে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। বিষয়টির খোঁজ নিয়ে দেখব।’ নিয়ম অনুযায়ী ফোনে একজন বন্দী ১০ মিনিট করে মাসে দুইবার কথা বলতে পারেন। পিসি (প্রিজনার ক্যাশ) কার্ডে স্বজনদের দেয়া টাকা থেকে প্রতি মিনিটে এক টাকা বিল নেয়ার কথা। চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে না পেরে অনেক বন্দীর টেলিফোনে স্বজনদের সাথে কথা বলার সৌভাগ্য হয় না। দুই হাজার ২৪৯ জন বন্দীর ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চট্টগ্রাম কারাগারে গড়ে ছয় হাজারের বেশি বন্দী থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড এন্ড বাংলাদেশ এর সহায়তায় এ কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালে।

 

কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে আসা একাধিক বন্দী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কারাগারের টেলিফোন ঘিরে চলে টাকার খেলা। একজন জমাদার মাসিক চুক্তিভিত্তিক এ টেলিফোন নিয়ন্ত্রণ করেন। স্বজনদের সাথে কথা বলতে মিনিটপ্রতি এক টাকা করে বিল এখন ‘কথার কথা’। বাস্তবতা হচ্ছে মাধ্যম না ধরে টেলিফোনে কথা বলা যায় না। যেমন- কারাগারের আইজি (প্রিজন) এর দুইজন গোয়েন্দার কোটায় দিনে ৪০ জন, কারারক্ষীর কোটায় ৫ জন, জামাদারের কোটায় ২০ জন, সুবেদারের কোটায় ২০ জন, সিআইডি জমাদারের কোটায় ১০ জন, সকাল ও বিকালে দুইজন সুবেদারের কোটায় ১৫ জন করে ৩০ জন এবং জেলারের কোটায় ১২ জন বন্দী কথা বলার সুযোগ পান। টেলিফোনে স্বজনদের সাথে কথা বলতে হলে এদের মাধ্যমেই যেতে হবে। এতে প্রতি ১০ মিনিট কথা বলতে গুনতে হবে ৫ থেকে ৬ শ’ টাকা। টাকা থাকলে যত খুশি কথা বলা যায়। ফলে এ টেলিফোনে কারাগারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, কর্মচারীদের মাসে আয় হয় অন্তত ১৫ লাখ টাকা।

 

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মোহাম্মদ ইমরান টাকা নেয়ার কথা শুনে অনেকটা হতবাক হন। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কিছু হয় বলে মনে হয় না। আমি নতুন এসেছি, খোঁজ নিয়ে দেখব। আপনি খবর নিয়ে দেখবেন বন্দীদের কি ভালবাসা আমি দিচ্ছি। এ সব অভিযোগ শতভাগ মিথ্যে। কে বলেছে তার নাম বললে আমি দেখতে পারি। কোনো লোক এ ধরনের কথা বলে থাকলে ধরে নিতে হবে তার মাথার সমস্যা আাছে। একজন বন্দী একবার ১০ মিনিট কথা বলতে পারবে।। প্রতি মিনিট ১ টাকা করে বিল নেয়া হয়। বন্দীরা পিসি কার্ড থেকে এ টাকা পরিশোধ করে। নগদ টাকা দেয়ার সুযোগ নেই। টাকা দিয়ে কেউ আমাকে কিনতে পারবে না। বন্দীরা হচ্ছে মজলুম। তাদের সেবা দিলে আল্লাহ খুশি হবেন।’

 

উল্লেখ্য ‘স্বজনদের সাথে সংশোধনের পথে’ স্লোগান সামনে নিয়ে টেলিফোনে কথা বলা এ কার্যক্রমের নামকরণ করা হয়েছে ‘স্বজন পরিবারের বন্ধন’। কারাগারে আসার পর বন্দীদের (হাজতী ও কয়েদি) কাছ থেকে স্বজনদের দুটি মুঠোফোন নম্বর রাখা হয়। কথা বলার ক্ষেত্রে নারী ও বৃদ্ধ বন্দীদের সঙ্গে শিশুদের অগ্রাধিকারের কথা বলা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী কোন বন্দী সরাসরি বুথে গিয়ে কথা বলতে পারবেন না।

নির্ধারিত সময়ে বন্দীরা বুথে ঢুকে এক বা দুই চাপলে সফটওয়্যার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট নম্বরে সংযোগ পাওয়া যাবে। নির্ধারিত ১০ মিনিট পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে কল কেটে যাবে। সময় শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে সতর্কতাসূচক ‘বিপ’ হবে। নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে কল ডায়াল হবে না। শুধু নির্ধারিত সময়ে কল করতে হবে। বন্দীদের স্বজনরা নির্ধারিত সময়ে যাতে কথা বলার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারেন, সেজন্য আগের দিন তাঁদের মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে সময় জানিয়ে দেয়া হয়। কারাবন্দীদের মানবিক দিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশে কারা প্রশাসনের উদ্যেগে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট