২২ আগস্ট, ২০২২ | ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ
নাজিম মুহাম্মদ
সিয়াম ও হেলাল। তেরো বছরের দুই শিশুর অপরাধ তারা মানুষের বাসার সামনে থেকে জুতো চুরি করে, বিভিন্ন ভবনের লোহার পাইপ চুরি করে, গাম সেবন করে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দুই শিশুকে রীতিমতো ধাওয়া করে ধরে এনে রশি দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে মারধর করা হয়। কেটে দেয়া হয় মাথার চুল। পরে শিশুদের বাসায় পৌঁছে দেয় পুলিশের দুই কনস্টেবল। গত শুক্রবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে নগরীর লালখান বাজার অফিসার্স কলোনির পুলিশ বক্সের সামনে।
কালোনির দারোয়ানের দাবি ওই দুই শিশু মস্তবড় অপরাধী। তাদের জ্বালায় কলোনির লোকজন অতিষ্ঠ। তাদের বিরুদ্ধে খুলশী থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। ঘটনার শিকার দুই শিশু হল, কুমিল্লার দেবীদ্বার থানার বিহার মণ্ডল গ্রামের আবদুল জব্বারের ছেলে মো. সিয়াম (১৩) ও নুর আলমের ছেলে মো. হেলাল (১৩)। এদের মধ্যে সিয়াম খুলশী থানার লালখান বাজার মতিঝর্ণা মসজিদের পাশে নান্টু ইঞ্জিনিয়ার ও হেলাল লালখান বাজার ১১ নং গলির আলমের ভবনের নিচ তলায় ভাড়া বাসায় পরিবারের সাথে থাকে।
খুলশী থানার পরিদর্শক (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা জানান, সিয়াম কিংবা হেলালের নামে থানায় কোন মামলা নেই।
সিয়ামের বড় ভাই কাউসার আহমদ জানান, তার ভাইটি অনেকটা ভবঘুরে হয়ে গেছে। ঘটনার পর থেকে তার সাথে আমার দেখা হয়নি। কি ঘটেছে আমি জানি না।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে হেলালের বাবা নুর আলম জানান, তিনি একটি ডেকোরেশনে বয়ের কাজ করেন। বর্তমানে কুমিল্লায় আছেন। এলাকার খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে সারাদিন বাসায় থাকে না ছেলেটি। ওইদিন কি হয়েছে আসলে আমি জানি না।
স্থানীয় লোকজন জানান, লালখান বাজার এলাকায় দুটি গ্রুপ বিদ্যামান। এরমধ্যে একটি গ্রুপের অনুসারি কলোনির দারোয়ান তাজুল। মূলত তাজুল কলোনির নিরাপত্তায় থাকা কনস্টেবলদের ব্যবহার করে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। গত রমজান মাসে তাজুলের সাথে প্রতিপক্ষের মারামারি হয়েছিল। এ ঘটনায় খুলশী থানায় মামলাও রয়েছে। তাজুলের বাড়িও কুমিল্লায়। বসবাস করেন মতিঝর্ণা মসজিদের পাশে।
তাজুলের দাবি, এ দুই শিশু বাসা বাড়ির পাইপ, জুতা যখন যা পায় তা চুরি করে। তারা কলোনির মুখে ব্রিজের নিচে বসে নিয়মিত গাম (রিকশার টায়ারে ব্যবহৃত) সেবন করে। কলোনির সামনে ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের দারোয়ানকে মারধর করে লোহার রডের টুকরো চুরি করে। ম্যাক্সের দারোয়ান ধাওয়া করলে সিয়াম ও বেলাল কলোনির মুখে ব্রিজের নিচে ঢুকে যায়। তাদের ধরতে গেলে পাথর ছুঁড়ে মারে। এরমধ্যে শিশুরা নালা থেকে উঠে লালখান বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
তাজুল বলেন, বিষয়টি কলোনির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা তিন পুলিশ কনস্টেবলকে জানালে তারাও ঘটনাস্থলে আসে। কনস্টেবলসহ মিলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে থেকে দুই শিশুকে ধরে আনা হয়।
শিশুদের মারধর, খুুঁটির সাথে রশি দিয়ে বাঁধা ও মাথার চুল কেটে দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দারোয়ান তাজুল বলেন, ওই কনস্টেবলরা খুঁটির সাথে সিয়াম ও হেলালকে বাঁধে। এরমধ্যে কেউ একজন সিয়ামের মাথার সামনের চুল কেটে দেয়। পরে একটি সিএনজি ট্যাক্সিতে তুলে দুই শিশুকে পরিবারের কাছে দিয়ে আসে পুলিশের দুই কনস্টেবল।
কলোনির মুখেই রয়েছে ব্রোস্ট রেস্টুরেন্ট। ওই রেস্টুরেন্টের নিরাপত্তা প্রহরী জহুরুল ইসলাম জানান, শিশুগুলো যখন কলোনির মুখে নালার ভেতরে ঢুকে যায় তখন পুলিশ কনস্টেবলদের ডাকা হয়। কনস্টেবলরা আসলে দারোয়ান তাজুলসহ শিশুদের ধাওয়া করে ধরে এনে কলোনির বক্সের সামনে লোহার খুঁটিতে রশি দিয়ে বাঁধে। ধরে আনার সময় লোকজন তাদের হালকা-পাতলা মারধরও করে। এদের মধ্যে শিশু সিয়ামের মাথার চুল কেটে দেয় কেউ একজন। পরে পুলিশ কনস্টেবলরা তাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ম্যাজিস্ট্রেট কলোনিতে একটি পুলিশ বক্স রয়েছে। কলোনির নিরাপত্তার দায়িত্বে প্রতিদিন তিনজন করে পুলিশ কনস্টেবল দায়িত্ব পালন করেন। শুক্রবার দায়িত্ব পালন করা তিন কনস্টেবলের মধ্যে দুই জনের নামা জানা যায়। তারা হলেন, মেহেদী হাসান ও মাজহারুল ইসলাম।
গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে কনস্টেবল মেহেদী হাসান জানান, আমরা নিয়ম অনুযায়ী কলোনির বক্সে ডিউটি করছিলাম। এরমধ্যে কলোনির মুখে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়। কেউ একজন আমাদের ডাক দিয়ে বলেন, কয়েকজন শিশু কলোনির মুখে ব্রিজের নিচে নেশা করছে। পরে তাদেরকে লালখান বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে থেকে ধরে নিয়ে আসে লোকজন। অনেকে শিশুদের মারধরও করেন। শিশুগুলোকে আমরা নিয়ে আসি। পরে বাসায় পৌঁছে দিয়েছি। ওই দুই শিশুর চুরির বিষয়ে কেউ আমাদের কিছু বলেনি।
কলোনির পুলিশ বক্সের সামনে শিশুদের খুঁটির রশি দিয়ে বাধা, মাথার চুল কেটে দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কনস্টেবল মেহেদী হাসান জানান, খুঁটিতে কে বেঁধেছে কিংবা কে চুল কেটেছে আমি দেখিনি। অনেক লোকজন ছিল। এরমধ্যে কে একজন এসে শিশুদের বাধা অবস্থায় ছবি তুলে নিয়ে যায়। আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে কাজটি করেছি।
পূর্বকোণ/আর