চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

রোহিঙ্গা ঠেকানোর কৌশলে গলদঘর্ম স্থানীয়রা

নিজস্ব প্রতিবেদক

২১ আগস্ট, ২০২২ | ১২:১৮ অপরাহ্ণ

সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া ইউনিয়নের নাজিম উদ্দিন। তিনি ও তার পূর্ব পুরুষ ওই এলাকার ভোটার। কিন্তু চলমান হালনাগাদে ছেলেকে ভোটার করাতে গিয়ে পদে পদে ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয় তাকে। ইসির চাহিদা মতো প্রতিস্বাক্ষরযুক্ত জমির দলিল ও চেয়ারম্যানের প্রত্যায়নপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে নতুন ভোটারদের একেবারে গলদঘর্ম অবস্থা। শুধু নাজিম উদ্দিনের নয়, সাতকানিয়ার শত শত লোকজনকে ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। একই অবস্থা বাঁশখালী উপজেলার নতুন ভোটারযোগ্য নাগরিকদেরও।

চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. কামরুল আলম গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালী, লোহাগাড়াসহ কয়েকটি উপজেলায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপক বসতি রয়েছে। রোহিঙ্গা ঠেকাতে এসব উপজেলায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কারণ ইতিমধ্যেই অনেক রোহিঙ্গা নাগরিক ভোটার হওয়ার পর ধরা পড়েছে। তথ্য সংগ্রহের পরও অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেছে। তবে প্রকৃত নাগরিকদের বিরুদ্ধে নিশ্চিত হওয়ার পর ছাড় দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’

 

সাতকানিয়ার নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘জায়গা-জমির দলিলে উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের প্রতিস্বাক্ষর নিতে হয়। এই প্রতিস্বাক্ষর নিতে গিয়ে ২০-৩০ কিলোমিটার দূরের বাসিন্দাদের পুরোদিন চলে যায়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের জাতীয়তা সনদ ও প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করতেও শত শত লোককে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, চেয়ারম্যানদের রীতিমতো সামিয়ানা টাঙিয়ে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে।’

কেওচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওচমান আলী বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের সব কাজ বাদ দিয়ে ভোটারযোগ্য নাগরিকদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জাতীয়তা-জন্মসনদ ও প্রত্যয়নপত্র দিতে গিয়ে পরিষদের মেম্বার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাত-দিন পরিশ্রম করতে হচ্ছে।’ রোহিঙ্গা নাগরিকদের ঠেকাতে গিয়ে প্রকৃত নাগরিকেরাও জটিলতায় পড়েছেন। বিষয়টি আরও সহজতর করা দরকার।’

সাতকানিয়া সংবাদদাতা ইকবাল মুন্না জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র এখন নাগরিকদের অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তাই হালনাগাদে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে সচেতন হয়েছেন নাগরিকেরা। কিন্তু ভোটার হতে গিয়ে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে সাতকানিয়াবাসীকে। ২০১৭ সালে এদেশে রোহিঙ্গা নাগরিকদের ব্যাপক আগমনের পর থেকে মূলত এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আগে পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্র ও প্রয়োজনীয়-গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র দিয়ে ভোটার হওয়া যেত। এখন ১৮ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হচ্ছে। এসবের মধ্যে তিন-পাঁচ ধরনের কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ভোটারযোগ্য নাগরিকেরা। বিশেষ করে জমির খতিয়ান উপজেলা ভূমি অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও তহসিলদারদের প্রতিস্বাক্ষরযুক্ত খতিয়ান জমা দিতে হয়। এই প্রতিস্বাক্ষরের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।

চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের আইনজীবী এডভোকেট রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘ভোটার ফরমের সাথে সত্যায়িত খতিয়ান নেওয়া হয়রানির সামিল। আমার বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। তাও রোহিঙ্গা নাগরিকেরা এদেশের আসার আগের। এটাই তো কমিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তবে বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই নতুন ভোটার হতে চায় তাহলে খতিয়ান বা অন্যান্য বাড়তি তথ্য চাওয়ার যৌক্তিকতা রয়েছে।’

উপজেলা ভূমি অফিস থেকে চরতী ইউনিয়ন, পুরানগড় ইউনিয়নের দূরত্ব প্রায় ১৭ কিলোমিটার। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে লোকজনকে খতিয়ানে প্রতিস্বাক্ষর নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। বাবর আলী নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘ছেলেকে ভোটার করানোর জন্য এক সপ্তাহ ধরে ঘোরাঘুরি করছি। কখনো ইউনিয়ন পরিষদে, কখনো ভূমি অফিসে। এখনো কাজ শেষ হয়নি। মনে হচ্ছে আমরাই রোহিঙ্গা হয়ে গেলাম।’

 

সৈয়দ মনসুর নামে পুরাণগড় ইউনিয়নের এক ব্যক্তি বলেন, ‘খতিয়ান সত্যায়িত করতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হলাম। নানা ধরনের কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজেকে দেশের নাগরিক নয়, মনে হচ্ছে যেন শরণার্থী।’ এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও অনেকেই ভোগান্তির বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়েছে।

জানতে চাইলে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবু তালেব মন্ডল বলেন, ‘আমরা কেবল নির্বাচন কমিশনের আদেশ বাস্তবায়ন করছি। আমাদের আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার নেই।’

সাতকানিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মং চিংনু মারমা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যেন ভোটার হতে না পারে সেই বিষয়ে কড়া নির্দেশনা আছে। বিশেষায়িত এলাকার জন্য খতিয়ান সত্যায়িত করার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা রয়েছে। সাতকানিয়া বিশেষায়িত এলাকা হওয়ায় খতিয়ান সত্যায়িত করাটা বাধ্যতামূলক।’

বাঁশখালী সংবাদদাতা অনুপম অভি জানান, উপজেলার ১৪ ইউনিয়ন ও পৌরসভায় নতুন ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিবাহিত নারী-পুরুষরা কাজি অফিসে গিয়ে বিবাহের কাবিননামা নিতে গিয়ে টাকা দিয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। তা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩শ টাকা করে গুনতে হচ্ছে ভোটারযোগ্য নাগরিকদের। কিছু কিছু এলাকায় ৫শ থেকে এক হাজার টাকা নিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। কাবিননামা সংগ্রহ করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন শত শত মানুষ। রোহিঙ্গা নন এই বিষয়ে প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

কাবিননামার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা নির্বাচন অফিসের অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. কামরুল আলম বলেন, ‘স্বামী জাতীয় পরিচয়পত্রে স্ত্রীর নাম না থাকলে প্রমাণ হিসেবে কাবিননামা জমা দিতে হবে। না হলে বিশেষ কমিটির সভায় উত্থাপনের পর প্রশ্ন উঠতে পারে।’

চাম্বল ইউনিয়নে গিয়ে ১নং ওয়ার্ডের ছমুদা খাতুন নামে এক মহিলা জানান, তার কন্যার বিবাহের কাবিননামা সংগ্রহ করতে গিয়ে কাজিকে ৩শ টাকা দিতে হয়েছে। হুমাইরা আক্তার নামে আরেক মহিলাও একই কথা বললেন। একাধিক কাজি অফিস ঘুরে মানুষের ভিড় দেখা গেছে।

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘ কাবিননামার নকল কপি তুলতে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়টি মৌখিকভাবে শুনেছি। লিখিত পেলে তা খতিয়ে দেখা হবে।’

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘এই আদেশটি হচ্ছে বিশেষায়িত এলাকার জন্য। এ আদেশে কেউ ভোগান্তির শিকার হলে বিশেষ কমিটিকে অবহিত করা হবে। বিশেষ কমিটি চাইলে যেকোন বিষয় শিথিল করতে পারে। ভিন দেশের কোনো নাগরিক যাতে আমাদের দেশের নাগরিকত্ব না পান তা নিশ্চিত করার জন্য মূলত এসব কাগজপত্র নেওয়া হচ্ছে।’

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট