চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চন্দনাইশে টিলা পরিণত পুকুরে

ইটভাটায় মাটির যোগান, সম্পূর্ণ নীরব ছিল প্রশাসন

মো. দেলোয়ার হোসেন, চন্দনাইশ

৭ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবুজে ঘেরা পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিনদিন হারিয়ে যেতে বসেছে। ভূমিদস্যুরা চন্দনাইশের দক্ষিণ হাশিমপুর সুখেন্দু পাহাড়কে কেটে পুকুরে পরিণত করেছে। প্রশাসন কোন এক অজানা কারণে সম্পূর্ণ নীরব ছিল। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি মাটি ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে সাবাড় করছে প্রভাবশালী মহল। বনবিভাগ কিংবা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অবহেলা, দায়িত্বহীনতার কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে যেতে বসলেও দেখার কেউ নেই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার দক্ষিণ হাশিমপুর সুখেন্দু পাহাড়ের টিলা চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে কেটে প্রভাবশালী মহল পার্শ্ববর্তী ইটভাটায় মাটির যোগান দিচ্ছিল দিন-দুপুরে। এ বিষয়ে ‘হাশিমপুর সুখেন্দু পাহাড়ের মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়’ শিরোনামে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয় দৈনিক পূর্বকোণে। কিন্তু থেমে থাকেনি অবৈধ পাহাড় কাটা। এ কারণে সুখেন্দু পাহাড় থেকে মাটি কেটে ভূমিদস্যুরা পুকুরে পরিণত করেছে কয়েক মাসে। বনবিভাগের পার্শ্ববর্তী জায়গায় গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো পাহাড় কেটে ইট তৈরি করছে প্রতিটি মৌসুমে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা ও সংরক্ষণের অভাবে উপজেলার কাঞ্চননগর, হাশিমপুর ও দোহাজারী এলাকায় নির্বিঘেœ পাহাড় ও পাহাড়ি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চন্দনাইশ উপজেলার পাহাড়ি এলাকার দক্ষিণ হাশিমপুর সুখেন্দু পাহাড়, লর্ট এলাহাবাদ, লর্ট শ্রীমাই, কাঞ্চননগরসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ের মাটি কেটে পরিবেশ ধ্বংস করছে এক শ্রেণির অসাধু মাটি ব্যবসায়ী। ভূমিদুস্যদের কালো থাবায় বিলীন হচ্ছে চন্দনাইশের পাহাড়ি টিলাগুলো।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার সুখেন্দু পাহাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় উঁচু-নিচু পাহাড়ের টিলা কেটে পুকুর ও সমতল করে যাচ্ছে ভূমিদস্যুরা। প্রশাসন কোন এক অজানা কারণে সম্পূর্ণ নীরব থেকে যায়। এ সকল পাহাড়ের মাটি বিভিন্ন ইটভাটা ও ভিটা ভরাটের যোগান দিচ্ছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদীরা। স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বন বিভাগের আওতাধীন একের পর এক পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করে বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনরকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
বিগত একযুগেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সময়ে একের পর এক পাহাড় কেটে সাবাড় করে দেয়া হচ্ছে মূল্যবান বনজ সম্পদ। সেইসাথে চন্দনাইশের ঐতিহ্যবাহী পেয়ারা বাগান, আনারস, কাঁঠাল ও লেবু বাগান। এ কারণে চন্দনাইশে নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। অবশিষ্ট থাকা পাহাড়গুলোকে জরুরি ভিত্তিতে রক্ষা করা না হলে এ অঞ্চলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে বলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বছরের পর বছর ধরে পাহাড়, নদী, খাল, সবুজ বনঘেঁষা দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশে পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠেছে ৩৭টির অধিক অবৈধ ইটভাটা। আর এসব ইটভাটাগুলোতে মাটি যোগান দিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পাহাড় কাটার মাটি ও ফসলি জমির টপসয়েল তথা উর্বর অংশ। প্রশাসনের নাকের ডগায় সর্বত্রই সমানতালে পাহাড় কাটা চললেও যেন কারো মাথা ব্যথা ছিল না। এ কারণে যা হবার তাই হয়েছে। পাহাড় কেটে পুকুর খনন করেছে ভূমিদস্যুরা। পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে স্থানীয় প্রভাবশালীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অবৈধ মাটি ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে স্ক্যাভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে ট্রাকে বোঝাই করে মাটি সরবরাহ করেছিল।
এ ব্যাপারে স্থানীয়রা জানান, সামান্য টাকার বিনিময়ে না বুঝে অনেকেই এ নগদ অর্থের দিকে ঝুঁকে পড়ে পাহাড়ের মাটি বিক্রি করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ.ন.ম বদরুদ্দোজা জানান, পাহাড় কাটার বিষয়ে শুনে তিনি সেসময় সেখানে গিয়ে কাউকে দেখতে পাননি। পাহাড় কাটা হচ্ছে শুনে বলেছিলেন, অবশ্যই তিনি সুখেন্দু পাহাড়ে গিয়ে পাহাড় কাটা বন্ধের ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু যথাযথভাবে ব্যবস্থা না নেয়ায় যা হবার তাই হয়েছে। পাহাড় কেটে পুকুর খনন করেছে ভূমিদস্যুরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট এন্ড এনভাইরেনমেন্টের প্রফেসর কামাল হোসেন বলেন, বেশ কয়েকবার পাহাড় ধসে পড়ে অনেক মানুষ মারা গেছে। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না পাহাড় কাটা। অবশিষ্ট পাহাড়কে রক্ষা করা না গেলে যেকোন সময় বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে। পাহাড় কাটার কারণে পাহাড়ের মাটি ধুয়ে পার্শ্ববর্তী নদী, পুকুর, জলাশয় ও জলাভূমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে বর্ষাকালে পানি ধরে রাখতে না পারায় হঠাৎ করে প্লাবিত হচ্ছে এলাকা। এতে করে শস্যের ক্ষতিসাধন হচ্ছে। এভাবে পাহাড় কাটা বন্ধ না হলে বর্ষা মৌসুমে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি আরো বাড়তে পারে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট