চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

স্ত্রী দেন চাকরির অফার, টাকা নেন স্বামী

রায়হান উদ্দিন

৭ আগস্ট, ২০২২ | ১১:১৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) কর্মচারী নিয়োগে তিন প্রার্থীর কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রেজিস্ট্রার অফিসের নিম্নমান সহকারী মানিক চন্দ্র দাশের বিরুদ্ধে। টাকা ফেরত চাইলে প্রার্থীকে প্রাণনাশের হুমকিও দেন মানিক। চাকরি না পেয়ে প্রতারণার অভিযোগে এবং টাকা ফেরত চেয়ে মানিককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন এক প্রার্থী। টাকা লেনদেনের ব্যাংক স্লিপ ও হুমকির ফোনালাপ পূর্বকোণের কাছে সংরক্ষিত আছে। তবে টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত মানিক চন্দ্র দাশ।

 

সম্প্রতি ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে নতুন করে অর্থিক লেনদেনে নিয়োগের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এলো। তবে ঘটনাটি প্রশাসনের নজরে আসার সাথে সাথেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে প্রশাসন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১ সালের ৩১ মে ও ১ জুন দুটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেখানে নিম্নমান সহকারী ও অফিস সহকারী পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে মাদারীপুরের রাকিব ফরাজী, সোহেল খান ও মাকসুদুল সালেহীনের কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা নেন রেজিস্ট্রার অফিসের নিম্নমান সহকারী মানিক চন্দ্র দাস। মানিকের ডাচ বাংলা ব্যাংক একাউন্ট ৭০৮১ এর মাধ্যমে টাকাগুলো নেয়া হয়।

টাকা গ্রহণের ফাঁস হওয়া ফোনালাপ

প্রার্থী : গেছে ৫০ (৫০ হাজার টাকা)?
মানিক চন্দ্র দাস : গেছে। তবে ভেজাল বাজাই (লাগিয়ে) দাও তুমি। ওইখানে ১০০ টাকা কেন চার্জ কেটে ফেলছে। চার্জসহ দিবা না? ৫০০ টাকা ঘটকা লাগায়ছো আমার।
প্রার্থী : তাইলে টোটাল কত হইলো?
মানিক : টোটাল বাসায় গিয়ে হিসেব করো। সাত ৭০ (৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা) এর লগে ৫০ (৫০ হাজার টাকা)।
প্রার্থী : ৮ লাখ ২০ হাজার।
মানিক : হ্যাঁ। ঠিক আছে।

ফাঁস হওয়া দ্বিতীয় ফোনালাপে হত্যার হুমকি
মানিক চন্দ্র দাস : তুমি আমারে চিনো? একদম খাইয়া ফেলবো, একদম পেটের মধ্যে মোচড় দিয়া খাইয়া ফেলবো তোরে।
প্রার্থী : আচ্ছা দেখা যাবে।
মানিক : পেটের মধ্যে মোচড় দিয়া খাইয়া ফেলবো কিন্তু একদম। পার্সনাল বিহেবিয়ার ঠিক করতে না পারলে খাইয়া ফেলবো একদম।
প্রার্থী : যত টাকা নিছেন, সব টাকা এই মাসের মধ্যেই দিবেন।
মানিক : এই বেটা কিসের টাকারে তোর, তুই জুলাইয়ের আগে এক টাকাও পাবি না। শোন্, তুই পরীক্ষা দিছোস। তোর এপ্লিকেন্ট পরীক্ষা দেক, তখন যদি না হয়, তুই ফুল টাকা পেয়ে যাবি একসাথে।
প্রার্থী : না, এই মাসের মধ্যেই দিবেন।

প্রশাসনের তদন্ত কমিটি গঠন
এদিকে কর্মচারী নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় গতকাল শনিবার বিকেলে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ৪ সদস্যের এই কমিটিতে শাহ আমানত হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক নির্মল কুমার সাহাকে আহ্বায়ক, সহকারী প্রক্টর মো. আহসানুল কবীর, ডেপুটি রেজিস্ট্রার রশীদুল হায়দার জাবেদকে সদস্য ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার সৈয়দ ফজলুল করিমকে সদস্য সচিব হিসেবে রাখা হয়েছে। কমিটিকে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনার কথা জানান রেজিস্ট্রার।

 

মাকসুদুল সালেহীন নামের এক প্রার্থী পূর্বকোণকে বলেন, ‘চাকরি দেওয়ার কথা বলে মানিক আমাদের তিনজনের কাছ থেকে এ পর্যন্ত ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন। শুধু আমার কাছ থেকেই ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা নিয়েছেন তিনি। প্রথমদিকে নিজ একাউন্টে টাকা নিলেও পরবর্তীতে তার একাউন্টে লিমিট শেষ হয়ে যাওয়ায় আরেক বন্ধুর একাউন্টে টাকা পাঠাতে বলেন।’

 

চাকরিতে টাকা লেনদেনের অফার দেওয়া হয় কার মাধ্যমে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানিকের স্ত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আমার ছাত্রী ছিল। মানিক তার স্ত্রী নিপার মাধ্যমে আমাদেরকে চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই এই অফার দেন।’ আরেক প্রার্থী সোহেল খান বলেন, ‘আমার কাছ থেকে মানিক চন্দ্র দাশ সাড়ে ৩ লাখ টাকা নিয়েছে। চাকরির নাম দিয়ে সে প্রতরণা করেছে। আমিও লিগ্যাল নোটিশ পাঠাবো শিগগিরই।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মানিক চন্দ্র দাস বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা। আমাকে ফাঁসানোর জন্য এটা করছে তারা। আমি আইনি পদক্ষেপ নেব।’ সব বিষয়ে কথা বলতে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে সময় চান মানিক।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স। এদের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। প্রশাসনকে বিপাকে ফেলতে তারা এসব কর্মকাণ্ড করছে। আমরা কাউকে ছাড় দিব না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে মানিককে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হবে।’

 

এর আগে, গত ৩ মার্চ ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত কয়েকটি অডিও ফোনালাপ ফাঁস হয়। এরপরে ৫ মার্চ সিন্ডিকেট সভায় এই নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশ বাতিল ও জড়িতদের শনাক্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনায় গত ৭ জুলাই অডিও ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় উপাচার্যের সাবেক পিএস খালেদ মিসবাহুল মোকররবীনকে পদাবনতি ও কর্মচারী আহমেদ হোসেনকে চাকরিচ্যুত করে সিন্ডিকেট।

 

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট