চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০৮ জুন, ২০২৩

সর্বশেষ:

২৪ মে, ২০২২ | ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ

পাইপলাইনই বসেনি ১৪% এলাকায়

মোহাম্মদ আলী 

নগরীর প্রান্তিক পর্যায়ের সব গ্রাহককে পানি সরবরাহ দিতে ওয়াসার সর্বমোট ১১৮০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো দরকার। গত ৬০ বছরে বসেছে ১০৩০ কিলোমিটার পাইপলাইন। অর্থাৎ নগরীর ১৪ শতাংশ এলাকায় এখনো ওয়াসার পাইপলাইন যায়নি। এরমধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে একটি ওয়ার্ডে কোন পাইপলাইনই বসেনি। আংশিক পাইপলাইন বসেছে ১৫টি ওয়ার্ডে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার দামপাড়া প্রধান কার্যালয় থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে নগরীর দক্ষিণ খুলশীর বাসিন্দারা এখনো ওয়াসার পানি পান না শুধু পাইপলাইন না থাকার কারণে। এলাকার বাসিন্দারা অগত্যা ওয়াসার পানির পরিবর্তে গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে।
ওয়াসা সূত্র জানায়, পুরো নগরীতে ওয়াসার বিভিন্ন ব্যাসার্ধের সরবরাহ লাইন রয়েছে ১০৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৭০০ কিলোমিটার পুরাতন পাইপলাইন পরিবর্তন করে নতুন পাইপলাইন বসানো হয়েছে। অবশিষ্ট পাইপলাইন পরিবর্তন ও নতুন সংযোগের জন্য আরো একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকারি সেবা সংস্থাটি। এ প্রকল্পের আওতায় পুরো নগরীকে সংযোগের আওতায় আনতে নতুন আরো দেড়শ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো হবে।
প্রসঙ্গত, নগরীতে পানি সরবরাহে চট্টগ্রাম ওয়াসা সর্বোচ্চ ৪৮ ইঞ্চি থেকে সর্বনিম্ন ৪ ইঞ্চি সরবরাহ পাইপলাইন ব্যবহার করে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর সর্ব দক্ষিণে ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডে নেই ওয়াসার পানি সরবরাহ লাইন। গভীর নলকূপ ও পুকুরের পানি ব্যবহার করে এ ওয়ার্ডের মানুষ। এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩৭ নম্বর উত্তর-মধ্যম হালিশহর, ৩৮ নম্বর দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহর, ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর এবং ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা- এ চার ওয়ার্ডে ওয়াসার আংশিক সরবরাহ লাইন থাকলেও পানির চাপ থাকে না। তাতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয় বাসিন্দাদের। ওয়াসার পানি সংকটের এ চিত্র শুধু সাগর উপকূলীয় পাঁচ ওয়ার্ডে নয়, শহরের বিভিন্ন এলাকায়ও রয়েছে। খোদ ওয়াসার পানি উৎপাদন এলাকা মোহরা পানি শোধনাগারের পাশে নেই পানি সরবরাহ লাইন। মোহরার খেজুরতলার পর থেকে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত সড়কের উত্তর পাশে, এফআইডিসি এলাকার বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম ইনস্টিটিউট এলাকা এবং বৃহত্তর বাকলিয়ার অধিকাংশ এলাকায় পানির লাইন নেই।
জানতে চাইলে ৪১ নং দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছালেহ আহম্মদ চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, ‘এখানকার বাসিন্দারা যুুগ যুগ ওয়াসার পানির জন্য ধর্ণা দিচ্ছে। কিন্তু ওয়াসা এখনো পানির লাইন দিতে পারেনি। স্থানীয় বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে নলকূপের পানি ব্যবহার করছেন।’ একই কথা বললেন ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুল বারেক। পূর্বকোণকে তিনি বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের স্টিল মিল এলাকার কিছু অংশ ছাড়া কোথাও ওয়াসার লাইন নেই। জনগণ পানির সীমাহীন কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।’
নগরীর অন্যতম অভিজাত আবাসিক এলাকা দক্ষিণ খুলশী। এখানকার অধিকাংশ এলাকায় নেই ওয়াসার লাইন। এ এলাকার যেখানে ওয়াসার লাইন রয়েছে, সেখানে পানি পায় না স্থানীয় বাসিন্দারা। বাধ্য হয়ে তারা গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করছে। এ সুযোগে অনেকে নভীর নলকূপ বসিয়ে বাণিজ্যিকভাবে পানি সরবরাহ দিচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দক্ষিণ খুলশী জামে মসজিদ ও দারুল নাজাত হেফজখানার আশেপাশের এলাকায় ওয়াসার লাইন থাকলেও পানির চাপ নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করছে। এমনকি ৪ থেকে ৫টি বাড়ির মালিক একটি গভীর নলকূপ বসিয়ে এক সাথে ব্যবহার করছে।
মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি আলহাজ শামসুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, ‘দক্ষিণ খুলশী আবাসিক এলাকায় সামান্য অংশে ওয়াসার লাইন থাকলেও পানির চাপ নেই। তাই স্থানীয় লোকজন বাধ্য হয়ে গভীর নলকূপ ব্যবহার করছেন। অনেকে ওয়াসা ভাউজার থেকে পানি কিনে ব্যবহার করেন। এমনকি মসজিদে মিলে না ওয়াসার পানি। সেখানেও নলকূপ ব্যবহার করতে হচ্ছে।
দক্ষিণ খুলশীর ১ নম্বর রোডের সি ব্লকের ৬৭/জি বাড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘ওয়াসা এই এলাকায় পাইপলাইন দিয়েছে। তবে পানির চাপ না থাকায় আমরা সংযোগ নিইনি। গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করছি।’
এদিকে ৭ নং পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোবারক আলী পূর্বকোণকে বলেন, ‘এ ওয়ার্ডের রৌফাবাদ, পাহাড়িকা আবাসিক, সমবায় আবাসিক, মোহাম্মদনগর, শান্তিনগর, নাজিরপাড়া এলাকার হিন্দুপাড়ায় ওয়াসার পাইপলাইন নেই। লোকজন পানির জন্য সীমাহীন কষ্টে আছেন।’ 
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘২০১৫ ও ২০১৬ সালে ওয়াসার ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও সেনিটেশন প্রকল্প-১’ প্রকল্প প্রণয়নকালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয় সভায় মেয়রের উপস্থিতি কাউন্সিলরদের স্ব স্ব ওয়ার্ডের পাইপলাইনের চাহিদা চেয়ে ওয়াসাকে জানাতে বলি। কিন্তু কোন কাউন্সিলর তাদের ওয়ার্ডের পাইপলাইনের চাহিদার কথা আমাদের জানাতে পারেননি। বর্তমানে ওয়াসা পুরো নগরীতে নতুন ও পুরাতন আরো ৮০০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসাবে। এর মধ্যে ১৫০ কিলোমিটার বসবে নতুন। এরপর পুরো নগরী ওয়াসার পাইপলাইনের আওতায় আসবে।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ পূর্বকোণকে বলেন, ‘নগরীতে নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ হচ্ছে। এসব সড়ক কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে নতুন আবাসিক এলাকা। এসব আবাসিকে পাইপলাইন বসিয়ে পানি সরবরাহ করছে ওয়াসা। তবে নতুন পাইপলাইন বসানোর ক্ষেত্রে ওয়াসা প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। সড়কে নতুন পাইপলাইন বসানোর ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা নানা অজুহাত দেখিয়ে অনুমতি প্রদানে বিলম্ব করে। এ অবস্থায় দ্রুত কাজ শেষ করতে পারে না ওয়াসা। তাই পানি সরবরাহে দেরি হয়।’ 
ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী নগরীতে পানির চাহিদা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার। এর বিপরীতে ওয়াসা সরবরাহ দিতে পারে ৪৬ কোটি লিটার। সেবা সংস্থাটির পানি সরবরাহ বাড়লেও এখনো পুরো নগরীতে পাইপলাইন দিতে পারেনি ওয়াসা। এমনকি যেসব এলাকায় লাইন রয়েছে, এরমধ্যে বেশিভাগ এলাকায় পানির চাপ নেই। অনেকে পায় না নিয়মিত পানি।
এদিকে পুরো নগরীতে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও স্যানিটেশন প্রকল্প-২’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করছে ওয়াসা। বর্তমানে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পের অধীনে ৪৬টি স্মার্ট ডিস্ট্রিক মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ) হবে। প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির জন্য ৮০০ কিলোমিটার বিভিন্ন ব্যাসার্ধের নতুন পাইপলাইন বসানো হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন পুরো শহর ওয়াসার পাইপলাইনের আওতায় আসবে। ২০ হাজার নতুন সংযোগ ছাড়াও সব এলাকার গ্রাহক সমানভাবে পানি সরবরাহ পাবে।  
প্রকল্পটির প্রস্তুতিমূলক কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও সেনিটেশন প্রকল্প-১’ প্রকল্পের অধীনে নগরীর ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৪৩ হাজার সংযোগ ডিস্ট্রিক মিটারিং এরিয়ার (ডিএমএ) আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এরপর নগরীর অবশিষ্ট এলাকায় পানি সংযোগ নিশ্চিত এবং সমানভাবে পানি সরবরাহ দিতে ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও সেনিটেশন প্রকল্প-২’ আরো একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটি ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে।’

পূর্বকোণ/এস 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট