চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

কনফিডেন্স সিমেন্ট জেটিতে অত্যাধুনিক ই-ক্রেন

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৮ জুলাই, ২০১৯ | ২:৪১ পূর্বাহ্ণ

ঘণ্টায় ৩শ টন পণ্য খালাস
হ বেসরকারি জেটির কারণে চাপ
কমবে বন্দরের : আমদানিকারক
হ দ্রুত পণ্য খালাসে মাদারভেসেল
মালিকেরা প্রণোদনা দেয় : বন্দর

সদরঘাটে বন্দরের প্রাইভেট জেটিতে অত্যাধুনিক ক্রেন স্থাপন করেছে কনফিডেন্স সিমেন্ট। এর মাধ্যমে ঘণ্টায় তিন শ টন পণ্য খালাস করা যায়। যা পুরোনো ক্রেনের চেয়ে পাঁচ গুণ পণ্য খালাস করা সম্ভব। বেসরকারি জেটিতে দ্রুত পণ্য খালাসের কারণে বন্দরে জাহাজ জট কমে আসছে। একই সঙ্গে পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অতিরিক্ত মাশুল গুণা থেকেও অনেকটা রেহাই পাবে আমদানিকারকেরা।
বন্দর সূত্র জানায়, বহির্নোঙর ও বন্দরের জাহাজ জট কমানো এবং দ্রুত পণ্য খালাসের জন্য সদরঘাট এলাকায় পাঁচটি জেটি নির্মাণ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের জন্য এসব জেটি বেসরকারি খাতে ইজারা দেয়া হয়। পাঁচটি জেটির মধ্যে চারটি স্টিল সামগ্রী ও একটি সিমেন্ট পণ্য খালাসের জন্য ইজারা দেয়া হয়। ক্লিংকার পণ্য খালাসযোগ্য জেটির ইজারা পায় সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কনফিডেন্স সিমেন্ট লিমিটেড। বছরে সাড়ে চার কোটি টাকায় ইজারা পায় কনফিডেন্স। কনফিডেন্স সিমেন্ট কর্তৃপক্ষ জেটির ইজারা পাওয়ার পর তাতে অত্যাধুনিক ই-ক্রেন স্থাপন করে। যা বেসরকারি খাতে প্রথম উদ্যোগ। ইউরোপের বেলজিয়াম থেকে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রেনটি আমদানি করা হয়। এর মাধ্যমে ঘণ্টায় তিনশ টন পণ্য খালাস করা যায়। যা পুরোনো মেকানিক্যাল ক্রেনে চেয়ে চার গুণেরও বেশি পণ্য খালাস করা যায়। কনফিডেন্স সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন আহমদ পূর্বকোণকে বলেন, বেসরকারি খাতে জেটি ইজারার প্রক্রিয়াটি বন্দরের একটি অন্যন্য উদ্যোগ। বন্দর কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান হচ্ছেন ব্যবসায়ীবান্ধব। বন্দরের হ্যান্ডলিং দ্রুত করতে নানা উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছেন। উন্নতমানের আধুনিক ক্রেন স্থাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অতি বৃষ্টির কারণে বহির্নোঙরে জাহাজ জট সৃষ্টি হয়। সেই জট খুলতে অন্তত মাস থেকে দেড় মাস সময় লেগে যেতে পারে। এই জটে আমরা বন্দরে বার্থিং না পেলেও নিজেদের জেটি ব্যবহার করে দ্রুত পণ্য খালাসে সক্ষম হই। এতে উৎপাদনে কোন ধরনের বিঘœ ঘটেনি।
জানা যায়, ই-ক্রেনের মাধ্যমে ঘণ্টায় তিনশ টন পণ্য খালাস করা যায়। দিনে ১৫ ঘণ্টা চালু রাখা হলে প্রায় চার হাজার ৫শ টন পণ্য খালাস করা যাবে। বহির্নোঙর থেকে দুই দিনের মধ্যে পণ্য খালাস করা যায়। অথচ বন্দর জেটি দিয়ে পণ্য খালাসে সাধারণ ৮-১০ দিন পর্যন্ত লেগে যায়। আর অতিবৃষ্টি বা ঝড়-তুফানের মতো দুর্যোগে মাস থেকে দেড় মাস পর্যন্ত লেগে যায়। সেখানে বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়া জেটিগুলোতে পণ্য খালাস দ্রুত করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন) মো. জাফর আলম পূর্বকোণকে বলেন, ‘বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণে আরও ৫-৬টি জেটি নির্মাণ করা হবে। যাতে কার্গো হ্যান্ডলিং দ্রুত করা যায়।’ সদরঘাট জেটির বিষয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সদরঘাটের জেটিগুলো পড়ে ছিল। নৌকা-সাম্পান ভিড়ত। বন্দরের কার্যক্রম বাড়াতে আধুনিকায়ন করে বেসরকারি খাতে ইজারা দেয়া হয়। এসব কোম্পানিগুলো আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দ্রুত পণ্য খালাসে সক্ষম হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দ্রুত পণ্য খালাস করতে পারলে মাদারভেসেল মালিকেরা আমদানিকারকদের প্রণোদনা দেয়। কয়েকটি কোম্পানি ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত প্রণোদনা পেয়েছে।
দেখা যায়, সদরঘাটে জেটিতে মাঝারি মানের লাইটার জাহাজ থেকে ই-ক্রেনের মাধ্যমে ক্লিংকার পণ্য খালাস করচ্ছে। বড় আকারের ক্রেন দিয়ে ভাটার সময় নির্বিঘেœ পণ্য খালাস করা হচ্ছে। অথচ মেকানিক্যাল ক্রেন দিয়ে ভাটার সময় পণ্য খালাসে বিঘিœত হচ্ছে।
জেটি অপারেশন কর্মকর্তা তাজবিন হায়দার পূর্বকোণকে বলেন, ই-ক্রেনের মাধ্যমে জোয়ার-ভাটায় সমান তালে পণ্য খালাস করা যায়। কিন্তু মেকানিক্যাল ক্রেন হচ্ছে অনেকটা জোয়ারনির্ভর। ভাটা আর শীতকালে নদীর পানি কমে গেলে পণ্য খালাস বিঘিœত হয়। সেই তুলনায় অত্যাধুনিক ক্রেনটি অনেক বেশি উপযোগী। এক গ্রেভে দুই টন পণ্য খালাস করা যায়। ২০ টনের একটি ট্রাক ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে ভর্তি করা যায়। তিনি দাবি করেন, বিদ্যুৎ, পরিবহন ও শ্রমিক প্রস্তুত থাকলে ১৮শ টনের একটি জাহাজ থেকে ৬ ঘণ্টায় পণ্য খালাস করা সম্ভব।
দ্রত পণ্য খালাস করা হলেও জাহাজ ভাড়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন জেটি ব্যবহারকারীরা। তাদের দাবি, দ্রুত পণ্য খালাসের পরও জাহাজ ভাড়া বাড়তি নেয়া হচ্ছে। জাহাজ ভাড়া কমিয়ে রাখা হলে বেসরকারি জেটির ব্যবহার আরও কয়েক গুণ বাড়ানো যাবে। এরফলে বন্দর ও বহির্নোঙরে জাহাজ জট অনেকাংশে কমে আসবে। আমদানি-রপ্তানিকারক ও মাদারভেসেল মালিকদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি হবে। কারণ বহির্নোঙরে মাদারভেসেল থেকে পণ্য খালাসে দেরি হলে অতিরিক্ত মাশুল গুণতে হয় আমদানিকারককে। যার জন্য পণ্যের দাম বাড়তি হয়। যার প্রভাব পড়ে ভোক্তাদের উপর।
আমদানিকারকেরা জানায়, বহির্নোঙর থেকে সদরঘাট জেটিতে জাহাজ ভাড়া পড়ে প্রতিটনে ৪ দশমিক ৫ ডলার (৩৮০ টাকা)। বন্দর জেটিতে বার্থিং করা হলে সেই সাড়ে চার ডলার সাশ্রয় হবে আমদানিকারকদের। কিন্তু বন্দরে পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বহির্নোঙরে মাদারভেসেল অপেক্ষামাণ থাকে। এতে জাহাজ ভাড়া ছাড়াও অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হয় আমদানিকারকদের।
তবে ড্রেজিংয়ের অভাবে সদরঘাটে স্থাপিত জেটিতে জাহাজ ভিড়াতে সমস্যা হচ্ছে বলে জানায় জেটি ইজারাদাররা। নিয়মিত ড্রেজিং করা হলে এখানে বড় জাহাজ ভিড়ানো যাবে। এখন শুধু মাঝারিমানের জাহাজ ভিড়ানো যায়।
কনফিডেন্স সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বন্দরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছি আমরা। জেটিতে জাহাজ ভিড়ানোর সুবিধার জন্য নিজের উদ্যোগে নিয়মিতভাবে ড্রেজিং করতে হয়। ড্রেজিংয়ের জন্য বছরে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। তবে ড্রেজিংয়ের বড় বাঁধা হচ্ছে নদীর তলদেশে পলিথিন বা গার্মেন্ট জুটের স্তুপ।’ তিনি বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ভালোভাবে ড্রেজিং করলে প্রাইভেট জেটিগুলোর ব্যবহার আরও বাড়বে। বন্দরের উপর চাপ অনেকাংশে কমে আসবে। কারণ দেশের প্রবৃত্তি বৃদ্ধির ফলে আমদানি-রপ্তানি কয়েক গুণ বেড়েছে। বন্দর সম্প্রসারণও সম্ভব নয়। তাই প্রাইভেট জেটি নির্মাণ করে আমদানি-রপ্তানি এবং দেশের অর্থনীতিতে বড় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বেসরকারি জেটিগুলো।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট