২৮ জুলাই, ২০১৯ | ২:৪৪ পূর্বাহ্ণ
ইফতেখারুল ইসলাম
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের ওয়ার্ড এবং থানা পর্যায়ে কমিটি গঠনের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীদের অভিযোগ একতরফাভাবে তালিকা সংগ্রহ করে কমিটি গঠনের চেষ্টা করছেন নগর ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। মূলত মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির বাতিলের দাবিতে সভা-সমাবেশ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কাছে স্মারকলিপি প্রদানসহ নানা কর্মসূচি পালন এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা হওয়ার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে নগর ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এই কৌশল নিয়েছে বলে তাদের অভিযোগ।
তবে নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমদ ইমু পূর্বকোণকে বলেছেন, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে কোন কৌশল কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। যারা প্রকৃত ছাত্র এবং মাঠের রাজনীতি করে তারাই কমিটিতে স্থান পাবে। এখানে কে কার অনুসারী তা বিবেচ্য বিষয় নয়। বিবেচ্য বিষয় হল ছাত্রলীগের রাজনীতি করে কিনা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নগর ছাত্রলীগের ২৪ জন বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয় ২০১৩ সালের ৩০শে অক্টোবর। ওই কমিটিতে ওমরগণি এম.ই.এস কলেজের একাংশ একজন ছাত্রনেতার অনুসারী এবং সিটি কলেজের একাংশকে প্রাধান্য দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে বর্তমান সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন এবং অন্যান্য কলেজ, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা আকাক্সক্ষানুযায়ী পদ পদবী না পাওয়ায় ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এমনকি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একটি সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। সেই সংঘর্ষে তৎকালীন ছাত্রনেতা মেজবাহ উদ্দিন মোর্শেদ, আবুল মনসুর টিটুসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা গুরুতর আহত হন। সেই ঘটনায় আবুল মনসুর টিটু বাদি হয়ে তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনিসহ কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। পরবর্তীতে দীর্ঘ ৮ মাস পর ২০১৪ সালের ১৪ জুন কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু এবং সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি’র মতামতকে প্রাধান্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম মহানগরের সর্ববৃহৎ ২৫১ জনের কমিটি গঠন করা হয়। তবে কমিটির কলেবর নিয়েও নানামত আছে। কমিটিতে অছাত্র এবং বিবাহিতদের অনেকেই স্থান পায় বলে বিতর্ক উঠে। অসন্তোষ রোধে ওই কমিটি ২৫১ থেকে ২৯১ জনে উন্নিত করা হয়। আজ পর্যন্ত কমিটির নিজস্ব কর্মসূচিতে ২৯১ জনকে একত্রিত করে কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। কমিটি গঠনের পরে বর্তমান সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীদের আলাদা বলয় সৃষ্টি করে পাল্টা কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। একইভাবে ওমরগণি এম.ই.এস কলেজ ও সিটি কলেজের ছাত্রনেতাদের গ্রুপিংয়ের কারণে নগর ছাত্রলীগ বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক) শিপিং ব্যবসায়ীর সাথে বিরোধে জড়িয়ে কেন্দ্র হতে সাময়িক বহিষ্কার হন। পরবর্তীতে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হলে তিনি আবার সংগঠনের কর্মকা-ের সাথে সম্পৃক্ত হন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হাটহাজারী নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে হাজতবাস করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ ও কোচিং ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলামকে মারধরের ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যহতি গ্রহণ করেন। সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। কমিটির বয়স এখন পাঁচ বছর ৯ মাস। অর্থাৎ প্রায় ছয় বছর বয়সী এই কমিটি সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক, ইমু ও রনি ১, ২, ১০, ১৮ এই ৪ টি ওয়ার্ড ছাত্রলীগের কমিটি দিতে হন। ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে নবাগত ও অসাংগঠনিকদের পদ-পদবী দেয়া হয়েছে দাবি করে দুইটি ওয়ার্ডে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীদের স্বাক্ষরিত পাল্টা কমিটি ঘোষণা করা হয়। ১নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড ও ২নং জালালাবাদ ওয়ার্ডে ইমু/রনি স্বাক্ষরিত কমিটি অনুমোদন হয় ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর। সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী সহ-সভাপতি মো. শাকিল ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মঈনুর রহমান স্বাক্ষরিত ২নং জালালাবাদ ওয়ার্ড এবং ও ১নং দক্ষিন পাহাড়তলী ওয়ার্ডে পাল্টা কমিটি অনুমোদিত হয়, একই বছরের ২৬ অক্টোবর ও ০২ নভেম্বর। এছাড়াও সিটি মেয়র আ. জ. ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী সহ-সভাপতি- মো. শাকিল ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক- মো. মঈনুর রহমান স্বাক্ষরিত ২৩নং পাঠানটুলী ওয়ার্ডের কমিটি অনুমোদিত হয় ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর। কমিটি পাল্টা কমিটি ঘোষণার কারণে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে পরবর্তীতে অন্যান্য ওয়ার্ড কমিটি গঠন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এর পর ইমু-দস্তগীরের স্বাক্ষরে ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কলেজের কমিটি অনুমোদিত হয়। চট্টগ্রাম কলেজের কমিটি ঘোষণার পরেই ব্যাপক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এসব অস্থিরতার কারণে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকায় এবং সাংগঠনিক তৎপরতা কমে এলে এবং বহুধা বিভক্ত সংগঠন কর্মসূচি পালনের সময় পদ-পদবীধারী ২৯১ জন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির অধিকাংশ নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ইতোমধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি বাতিলের দাবিতে সভা সমাবেশ করতে থাকে একটি অংশ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটিগুলো ভেঙ্গে দেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করায় যে কোন মুহূর্তে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অবস্থায় নিজেদের সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ রক্ষায় চট্টগ্রাম মহানগরের আওতাধীন ১৫টি থানা ও ৪৩টি ওয়ার্ড (২টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডসহ) কমিটি একযোগে ঘোষণা করার প্রস্তুতি হিসেবে সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তালিকা সংগ্রহ করছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। সভাপতি সিটি কলেজের একটি বিশেষ অংশের এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ওমরগণি এম.ই.এস কলেজের একজন ছাত্রনেতার অনুসারী। আলোচ্য দুই কলেজ ছাড়াও অন্যান্য কলেজ ও ছাত্রনেতাদের অনুসারী নেতাকর্মীদের বাদ রেখে কমিটি গঠনের এই প্রক্রিয়ায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষণার আগ- মুহূর্তে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে এ কমিটি ঘোষণা করা হলে প্রতিটি ওয়ার্ড এবং থানায় ভিন্ন ভিন্ন নেতাকর্মীদের অনুসারীদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পরার আশংকা রয়েছে। একইভাবে বিগত সময়ে ১,২ ও ১০নং ওয়ার্ডের মতো পাল্টা-পাল্টি কমিটি ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে।
নগর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মঈন শাহরিয়ার পূর্বকোণকে বলেন, তাদের সাথে কোন ধরনের আলাপ-আলোচনা না করেই এক তরফা কমিটি গঠনের চেষ্টা চলছে। তবে ওয়ার্ড এবং থানা পর্যায়ে ছাত্রলীগের একতরফা কমিটি ঘোষণা করা হলে ছাত্রলীগের মাঝে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু পূর্বকোণকে বলেন, সেপ্টেম্বরে সব ওয়ার্ড এবং থানা পর্যায়ের কমিটি গঠনের কাজ সম্পন্ন করা হবে। এই লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক নেতাদের কাছ থেকে তালিকা নেয়া হচ্ছে। কারণ আমরা যারা দায়িত্ব পালন করছি তাদের পক্ষে সবাইকে চেনা বা সবার সম্পর্কে ভালভাবে জানা সম্ভব নয়। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে কে কার অনুসারী তা বিবেচনা করা হবে না। আমরা চাইব যারা ছাত্র এবং রাজনীতিতে সক্রিয় তারাই কমিটিতে স্থান পাক। পুরানো কলেজগুলির কমিটি কিভাবে করা হবে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। তবে নতুন কলেজগুলির কমিটি অবশ্যই হয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন পূর্বকোণকে বলেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ার কারণে কৌশল হিসেবে কমিটি দেয়ার চেষ্টা চলছে। দেশের বিভিন্ন জেলা এবং মহানগরে নতুন কমিটি ঘোষণা হচ্ছে। এখানেও হতে পারে। এই নগরে ছাত্রলীগের রাজনীতি নিজেদের আয়ত্তে রাখতে এক তরফাভাবে ওয়ার্ড এবং থানা পর্যায়ের কমিটি গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত আছে বিয়ে করলেই পদ চলে যাবে। কিন্তু নগর কমিটির অধিকাংশ নেতা বিবাহিত। কেউ পদ ছাড়েনি। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন ৩১ জুলাই রাত ১২টার আগে বেশকিছু ওয়ার্ড এবং থানা কমিটি ঘোষণা হতে পারে। পরদিন যেহেতু শোকের মাস শুরু হচ্ছে। শোকের মাসে কেউ আন্দোলন করতে যাবে না। তাই তারা শোকের মাস শুরুর আগের দিন কিছু কমিটি ঘোষণার পাঁয়তারা করছে।