চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সেবক বেশে দালাল

চমেক হাসপাতালে বহিঃবিভাগ

ইমাম হোসেন রাজু

৩ মে, ২০১৯ | ২:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ফয়সাল। সকাল আটটার আগেই হাজির হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বহিঃবিভাগের মেডিসিন বিভাগে। রোগীদের আসতে দেরি হলেও ফয়সালের দেরি হয় না মোটেও। রোগীরা টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়ায় আর ফয়সাল লাইনের পাশেই তথা চিকিৎসকের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। একটা রোগী বের হলেই প্রেসক্রিপশন দেখে রোগীকে পরামর্শ দেয়াই তার কাজ। দেখে মনে হবে মানবতার সেবক। তবে বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। সে বেসরকারি একটি ল্যাবে কমিশন ভিত্তিক কাজ করে থাকে। অর্থ্যাৎ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে রোগীকে ওই ল্যাব বা ডায়গনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যাওয়াই তার কাজ। অনেক রোগী বা স্বজন ফয়সালের কথার ফাঁদে পড়লেও অনেকেই কান না পেতে উল্টো ধমক দেয়। তবে এতে যেন তার কিছুই আসে যায়না। বরং আগের মতোই সে তার কাজে ব্যস্ত। শুধু ফয়সাল নয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বহিঃ বিভাগে এমন অসংখ্য ফয়সালই প্রতিনিয়ত এ ধরণের কাজ করে থাকে। যাদের কাজই হল রোগীদের ভাগিয়ে নিয়ে বিভিন্ন ল্যাব বা ডায়গনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যাওয়া। এতে মোটা অংকের টাকাও পায় তারা। যার কারণে অনেক সময় রোগীদের পড়তে হয় দুর্ভোগেও। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চমেক হাসপাতালের বহিঃ বিভাগে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা রোগীরা চিকিৎসার জন্য আসলে তাদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখায় এসব দালালরা।

অনেক ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের সেবার মান নিয়েও বিভিন্ন ভাবে বিভ্রান্তি করে রোগী ও স্বজনকে। আবার যারা ল্যাব বা ডায়গনস্টিক সেন্টারের হয়ে কাজ করে তারা সরকারি হাসপাতালে পরিক্ষা-নিরীক্ষা ভাল নয়, এমন বলে বিভ্রান্তি করে তোলে রোগীকে। এভাবেই ভাগিয়ে নিয়ে পছন্দকৃত হাসপাতাল, ল্যাব, ডায়গনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দেয় এসব দালাল।
সরেজমিনে মেডিকেলের বহিঃবিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, বহিঃবিভাগের মেডিসিন বিভাগরে পুরুষ কক্ষে লাইন ধরে অসংখ্য রোগী চিকিৎসকের সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছে। রোগীদের লাইনের পাশেই এবং চিকিৎসকের কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন ল্যাব ও ডায়গনস্টিকের লোক। চিকিৎসকের কক্ষ থেকে একজন রোগী বের হলেই তাদের পেছনে ছুটেন তারা। কাছে গিয়ে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে রোগীদের বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে যাচ্ছে। পাশেই মেডিসিন বিভাগের মহিলা ওয়ার্ড। সেখানেও দেখা গেছে একই চিত্র। এমনকি ডাক্তারের রুমের পাশে থাকা যে টেবিল রয়েছে, তাতে পায়ের উপর পা রেখেই চিকিৎসকের মতোই পারামর্শ দিয়ে যাচ্ছে তারা। দেখে মনে হবে, হাসপাতালে বড় কোন কর্মকর্তা।
কাছে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে প্রতিবেদককে বলে, ‘আমার নাম রুবেল। আমি হাসপাতালের কেউ নয়। তবে সবার সাথেই আমার ভালো পরিচয় রয়েছে। পাশের একটি ল্যাবে কাজ করি।’ কি ধরণের কাজ করে জানতে চাইলে রোবেল বলে,‘আমার কাজ হচ্ছে এখানে যেসব রোগী আসে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো। বিনিময়ে আমি কিছু কমিশন পাই।’
রোবেল মতোই নগরীর প্রথম সারির এক হাসপাতালে দুই কর্মচারী ফয়সাল ও রনিও মহিলা রোগীদের বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে রোগীর সঙ্গে তার ঝগড়াও বাঁধে।
জানতে চাইলে ওই রোগী পূর্বকোণকে বলেন, ‘ওই লোক আমাকে বলে এটা সরকারি হাসপাতাল। এখানে পরীক্ষা করালে ভালো হবে না। টাকাও বেশি নেবে। বাইরে ভালো ল্যাব রয়েছে, তাতে কম টাকায় ভালো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালে ভালো হবে। আমি জানি তারা দলাল। তাই তাকে কথা না বলতে বলেছি। আর সে আমাকে উল্টো-পাল্টা কথা বলা শুরু করেছে।’
এসব দালালদের সঙ্গে হাসপাতালের একশ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগাযোগ রয়েছে। তারাও দালালদের কাজে সবসময় সহযোগিতা করে থাকে। শুধু দালালদের সাহায্য নয়, কোন দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হবে এমন পারামর্শও হাসপাতালের কর্মচারীরা দিয়ে থাকেন রোগীকে। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দালাল মুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছেন হাসপাতালকে। তবে রোগীদের হয়রানি ও ভাগিয়ে নেয়ার এমন অসংখ্য নজির রয়েছে বৃহত্তর চট্টগ্রামের একমাত্র সেবাকেন্দ্রটির।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আখতারুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন,‘দালাল মুক্ত রাখতে আমাদের সিসি টিভি ক্যামরা স্থাপন করা হয়েছে। আমরা সবসময় ক্যামরায় নজর রাখি। কাউকে সন্দেহ হলে তাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তাছাড়া আমরা নিজেরাও মাঝেমধ্যে গিয়ে অভিযান চালিয়ে থাকি। এখন থেকে আরও বেশি নজর দেয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন,‘হাসপাতালে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী আসা যাওয়া করে থাকে। এদের মধ্যে কে দালাল বা কে রোগী চেনা বড় দায়। আমাদের কোন কর্মচারী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে তাদের বিরুদ্ধেও আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে রোগী বা স্বজনকে এসব বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। কেউ যদি এমন শিকার হয়, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানালে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট