চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পলিথিন আহরণকারীরা

প্রতিরোধক না থাকায় ভুগছেন ক্যান্সার ও বিভিন্ন চর্মরোগে

ইমাম হোসাইন রাজু

২৫ জুলাই, ২০১৯ | ১:৫৬ পূর্বাহ্ণ

কল্পলোক আবাসিকের অদূরে ছোট্ট একটি বেড়ার কক্ষ। ভেতরে পলিথিন বাছাই করছিলেন ৩৫ বছর বয়সী জবা। স্বামী রিকশা চালান। আছে দুই সন্তান। সংসারের খরচ জোগাতে বাড়তি আয়ের আশায় পলিথিন বাছাইয়ের কাজ করেন তিনি। জানালেন, গার্মেন্টস থেকে বস্তায় বস্তায় বিভিন্ন ধরণের পলিথিন এই ঘরে আসার পর তারা কয়েকজন সকাল থেকে সারাদিন বাছাই করেন। ছেঁড়া-ফাটা ও টেপ লাগানো জিনিস কেটে পরিষ্কার করতে হয় পলিথিন। এছাড়া ময়লা পরিষ্কার করে ভাঁজ করে আবার বস্তায় ভরতে হয় তাদের। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা/৮টা পর্যন্ত কাজ করে প্রতিজন দৈনিক মজুরি পান ১৬০ টাকা করে।
নগরীর রাজাখালী এলাকায় গেলে যে কারোরই চোখে পড়বে ছোট ছোট এসব দোকানঘর। টিন আর বাঁশের তৈরি এসব দোকানের কোনোটাতে তরুণ কিশোর আর বয়স্ক মহিলারা খুঁজে পাওয়া পলিথিন থেকে ময়লা বের করছেন। কেউ আবার বস্তা থেকে খুঁজে বের করছেন প্লাস্টিক। কোনো দোকানে দেখা যাবে কয়েকজন তরুণ-তরুণী পলিথিনের স্তূপের নিচে বসে কী যেন বাছাই করছেন। কিছুদূর গেলে দেখা মিলবে লবনের সারি সারি কারখানার। সবকটি কাঁচা বা কাঁচা-পাকা। নগরীর বক্সিরহাট ওয়ার্ডের আরও অনেক স্থানে একই চিত্র মিললেও কোথাও চোখে পড়েনি স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ। কম টাকার এসব শ্রমিকদের নেই কোন নিরাপত্তা। দিনশেষে শ’দুয়েক টাকার জন্যই দিনে ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি শ্রম দিচ্ছেন এসব শ্রমিক। সরেজমিন বক্সিরহাট ওয়ার্ডের রাজাখালী এলাকায় গিয়ে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের দিনকাল। জানালেন তাদের যাপিত জীবনের গল্প। কল্পলোক আবাসিকের আরেকটি আধাপাকা ঘরে দেখা গেল পলিথিনের স্তূপ। যেন পাহাড়। বসে বাছাই করছেন কয়েকজন তরুণ আর

তরুণী। তারা জানালেন, এই ঘরেই তারা পলিথিন বাছাই করে মেশিনে দানা তৈরি করেন। পরে প্যাকেট করে প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে পাঠান। পলিথিনের কাজ করা এসব শ্রমিকদের দেখা গেছে গ্লাভস ও মাস্ক ছাড়া কাজ করতে। জিজ্ঞেস করলে তারা হেসেই উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এসব আবার কী?’
খোলা হাতে ময়লা ধরার ফলে এবং ধুলোবালি নাকে মুখে আসার কারণে নানা রোগে দিকে ধাবিত হচ্ছেন এসব শ্রমিক। পাশাপাশি রয়েছে, লবন আর সরিষার তেল উৎপাদন করাখানা। এই দুটি কারখানায় দেখা গেল শ্রমিকদের নিরাপত্তার কোন বালাই নেই। সবকটি লবণ কারখানার শ্রমিকরা নোংরা ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে কাজ করেন। নেই কোনো গ্লাভস আর গামবুট। নেই মাস্ক। খালি হাতে ও পায়ে কাজ করতে গিয়ে তাদের হাত ও পা ক্ষয় হচ্ছে। পড়ছেন নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
শ্রমিকরা বলছেন, তারা গরীব মানুষ, মালিক যেভাবে চালায় সেভাবেই চলেন। শরীরের ক্ষতি জেনেও কাজ না করে উপায় নেই তাদের। এছাড়া, সরিষার তেল তৈরির কারখানায় দেখা গেছে গরমে সেদ্ধ হচ্ছে শ্রমিকরা। যাদের অধিকাংশ মহিলা। তারা জানালেন, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টানা কাজ করেন তারা। নেই নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা। প্রায়ই শ্রমিকরা মেশিনে দুর্ঘটনার শিকার হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী শ্রমিক জানান, নারীদের প্রাকৃতিক বিভিন্ন সমস্যার সময়েও তাদের কাজ করতে হয়। টানা গরমে কাজ করতে গিয়ে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েন তারা। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী আবরার হাসান জানান, ‘গ্লাভস, মাস্ক আর নির্দিষ্ট পায়ের জুতা দীর্ঘদিন ব্যবহার না করে লবণ, পলিথিন শিল্পে কাজ করার ফলে নি¤œ আয়ের মানুষের চর্মরোগ হতে পারে। এমনকি চর্ম ক্যান্সারের ঝুঁকিও রয়েছে। আর নিয়মিত (সাধারণ নয়) বিশেষায়িত মাস্ক ব্যবহার না করলে ‘কেমিক্যাল নিউমোনাইটিস’ নামের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে’। এদিকে এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের কর্মপরিবেশ সুন্দর ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে সরাকারের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাও কাজ করে যাচ্ছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট