চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ডায়মন্ড সিমেন্ট দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ১:২৯ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশের বেসরকারিখাতে প্রথম দিকের উৎপাদনে যাওয়া একটি প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেড। নব্বই দশকে চট্টগ্রামে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আসে তাদের মধ্যে অন্যতম ডায়মন্ড সিমেন্ট। দেশের উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়তে এ দেশের বৃহত্তম এবং সুপরিচিত সিমেন্ট প্রস্তুতকারক ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেড অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তির কারিগরি জ্ঞান, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, মান নিয়ন্ত্রণ ও পেশাদারিত্ব নিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের অভিযাত্রায় ব্যাপক অবদান রাখার ক্ষেত্রে ডায়মন্ড সিমেন্ট আস্থাশীল। দেশের সিমেন্টখাতের অবস্থা এবং ডায়মন্ড সিমেন্টের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে পূর্বকোণের সাথে কথা বলেছেন ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ হাকিম আলী।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক ইমাম হোসাইন রাজু

পূর্বকোণ : করোনার কারণে অন্য ব্যবসার মতো সিমেন্ট ব্যবসাতেও মন্দাভাব তৈরি হয়েছিল। সেই মন্দা কেটেছে কি?
হাকিম আলী : করোনার কারণে সিমেন্ট ব্যবসায়ে যে ভয়াবহ মন্দাভাব ছিলো তা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে বলে আমি মনে করি। তবে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের আমদানি খরচ প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব বিদ্যমান। ফলে নির্মাণ শিল্পের সকল পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। যা অনেকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। পাশাপাশি করোনা পরবর্তী বৈদেশিক রেমিটেন্স এ কিছুটা মন্দাভাব থাকায় গ্রামাঞ্চলে নির্মাণ কাজে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারপরও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের কাজ পুরো দমে শুরু হওয়ায় এই শিল্পের মন্দাভাব দ্রুতই কেটে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
পূর্বকোণ : আপনাদের প্রতিষ্ঠান ও পণ্য সম্পর্কে জানতে চাই?
হাকিম আলী :দেশের বেসরকারিখাতে প্রথম দিকের উৎপাদনে যাওয়া প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ডায়মন্ড সিমেন্ট। প্রতিনিয়ত আমরা গুণগতমানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করে দেশের নির্মাণ শিল্পে অবদান রেখে যাচ্ছি। নব্বইয়ের দশকে চট্টগ্রামে যে ২/৩ টি প্রতিষ্ঠান প্রথমে সিমেন্ট উৎপাদনে আসে তাদের মধ্যে ডায়মন্ড সিমেন্ট অন্যতম। বর্তমানে আমরা চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন গ্রামে সিমেন্ট পৌঁছে দেই। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আমরা ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত ত্রিপুরায় সিমেন্ট বিপণন করে থাকি। বর্তমানে আমাদের ৩ টি ব্র্যান্ড মার্কেটে রয়েছে। ডায়মন্ড এক্সট্রিম, ডায়মন্ড কোস্টাল প্লাস, অর্ডিনারি পোর্টল্যাণ্ড সিমেন্ট।
পূর্বকোণ : বাংলাদেশের অন্য সিমেন্টের চেয়ে ডায়মন্ড সিমেন্টের ভিন্নতা কোথায়?
হাকিম আলী : ডায়মন্ড সিমেন্টের অন্যতম ভিন্নতা হচ্ছে তার মান। দেশের অন্যান্য সিমেন্টের টেস্ট রেজাল্টে যখন সময়ে সময়ে ভিন্ন রেজাল্ট আসে, সেখানে আমাদের গুণাগুণ, মান এবং টেস্ট রেজাল্ট-এ সবসময় একটি নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখা হয়। বিশে^র সেরা সব জায়গা থেকে আমরা ক্লিংকারসহ অন্যান্য কাঁচামাল ক্রয় করে থাকি। আমাদের আছে আধুনিক এবং মানসম্পন্ন কাঁচামাল সংরক্ষণ ব্যবস্থা। উপকূলীয় অঞ্চলের চাহিদা চিন্তা করে দেশে আমরাই প্রথম এবং একমাত্র লবণাক্ততা এবং ফাটল প্রতিরোধী সিমেন্ট ডায়মন্ড কোস্টাল প্লাস বাজারে এনেছি।
পূর্বকোণ : সরকারের কোন কোন বড় প্রকল্পে আপনাদের সিমেন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে?
হাকিম আলী : দেশের ছোট বড় বেশ কিছু প্রকল্পেই ডায়মন্ট সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। বিশেষ করে বিদেশি কোম্পানিগুলো যে বড় প্রকল্পের কাজ করছে, তারাই ডায়মন্ড সিমেন্টকে বেশি পছন্দ করছে। উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার কর্ণফুলী টানেল কন্সট্রাকশন, ৩৬ হাজার কোটি টাকার মাতারবাড়ি পাওয়ার প্লান্ট, ১১ হাজার কোটি টাকার সিডিএ’র ওয়াটার লগিং প্রজেক্ট, ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার কক্সবাজার এয়ারপোর্ট রানওয়ে এক্সটেনশান ওয়ার্ক, চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট রানওয়ে এক্সটেনশান ওয়ার্ক, সিডিএ’র চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড় প্রজেক্ট, বাংলাদেশের প্রথম হাইটেক প্রকল্প শেখ জামাল ইনকিউভেটর প্রকল্প, কক্সবাজারের খুরুসকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প, হালিশহরের মুজিব ব্যাটারি কমপ্লেক্স প্রকল্প অন্যতম।
পূর্বকোণ : বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্পের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
হাকিম আলী : বাংলাদেশে সিমেন্ট শিল্পের সম্ভাবনা প্রচুর। মাথাপিছু সিমেন্ট এর ব্যবহারের হারে আমরা এখনো প্রতিবেশী যেকোন দেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছি। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত। গ্রামাঞ্চলে এখন আর কাঁচা ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে না। তাই সিমেন্ট এর চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে। উন্নত দেশগুলোতে মাথাপিছু সিমেন্ট ব্যবহৃত হয় প্রায় ৫০০-৬০০ কেজি। বর্তমানে আমাদের দেশে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার প্রায় ১৮০ কেজি। সে তুলনায় আমাদের দেশের ব্যবহার এখনো অনেক কম। যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বর্ধিত চাহিদা পূরণে সিমেন্টের যোগান বৃদ্ধি করতে হবে। কাজেই আরও অনেকটা সময় বাংলাদেশে সিমেন্ট শিল্পের সম্ভাবনা আছে।
পূর্বকোণ : সিমেন্ট রপ্তানির সম্ভাবনা কতটুকু? সম্ভাবনা ধরতে কি কি করণীয়?
হাকিম আলী : বাংলাদেশ থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত অঞ্চলগুলো এবং মিয়ানমারে সিমেন্ট রপ্তানি হয়ে থাকে। ২০১৯-২০২০ সালে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৮.৩ বিলিয়ন ডলারের সিমেন্ট। সেসবখানে আমাদের সিমেন্টের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এবং তা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানিতে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতে সিমেন্ট রপ্তানির সম্ভাবনা ধরতে ভারতীয় লাইসেন্স প্রাপ্তি সহজলভ্য করতে হবে। তাছাড়া এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
পূর্বকোণ : বর্তমান সিমেন্ট শিল্পের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী?
হাকিম আলী : সিমেন্ট শিল্পের বর্তমানে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো অসম প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশে সিমেন্টের মোট চাহিদার চেয়ে মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ। তাই প্রতিনিয়ত বাজার ধরার জন্য কোম্পানিগুলো দাম নির্ধারণ নিয়ে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তাই মুনাফা করতে না পেরে এবং ব্যাংক লোনের সুদের উচ্চ হারের কারণে অনেক কোম্পানি ধীরে ধীরে বাজার থেকে ঝরে যাচ্ছে। বেশিরভাগ কোম্পানিই কোন মুনাফা করতে পারছে না। পাশাপাশি কাঁচামাল আমদানিতে সরকারের উচ্চ কর হার, ব্যাংক লোন সহজলভ্য না হওয়া, বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ইত্যাদিও এই শিল্প বিকাশে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা বলে আমি মনে করি।
পূর্বকোণ : কোস্টাল প্লাসের সম্পর্কে একটু জানতে চাই।
হাকিম আলী : কক্সবাজারের টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরার রায়মঙ্গল কালিন্দী নদী পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে জোয়ার ভাটার প্রভাব, নোনা পানির অনুপ্রবেশ এবং ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াসের প্রভাব বলয়যুক্ত এই অঞ্চলের পুরোটাই ক্ষয়প্রবণ। তার উপর রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি। ডায়মন্ট কোস্টাল প্লাস বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি পোর্টল্যান্ড প্ল্যাগ সিমেন্ট যাতে পানি মেশালে ট্রাইক্যালসিয়াম সিলিকেট ও ড্রাইক্যালসিয়াম সিলিকেট গঠিত হয়। তাছাড়া এই সিমেন্টের হাইড্রেশনের হার সাধারণ পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ধীরগতি সম্পন্ন, যা তাপমাত্রা বাড়ার কারণে ফাটল দেখা দেয়ার আশঙ্কা কমিয়ে কংক্রিটকে ভেদ্যতা প্রতিরোধী করে তোলে। তাই বাজারে প্রচলিত যে কোন সিমেন্টের চেয়ে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ঠেকানো ও ক্ষয়রোধে অনেক বেশি কার্যকর ডায়মন্ড কোস্টাল প্লাস যা ব্যবহারে স্থাপনা হবে টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী। যা রুক্ষ জলবায়ু, লবণাক্ততা ও আদ্রতা থেকে রক্ষা করে স্থাপনাকে।

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট