চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সিমেন্ট শিল্প রপ্তানির অমিত সম্ভাবনা

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ১২:৫৭ অপরাহ্ণ

ইমাম হোসাইন রাজু

 

এক সময়ে দেশের বাজারে বিদেশি সিমেন্টের রাজত্ব থাকলেও সেটি এখন পুরোপুরিই দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে। ক্রমেই তার পরিসর বাড়ছে। বলা চলে সিমেন্টের বাজার এখন প্রায় পুরোপুরিই দখলে রেখেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু তাই নয়, দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশি সিমেন্ট অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। গুণগত মানসম্পন্ন বাংলাদেশি সিমেন্টের কদর বিশ^ বাজারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্ভাবনাময় সিমেন্ট শিল্পের এ উত্থানের ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
সিমেন্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দুই দশক ধরে দেশের সিমেন্ট শিল্প অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশের সিমেন্টের মানও অনেক উন্নত হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের সিমেন্ট উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। বর্তমানে দেশে ৩৪ টি সিমেন্ট কারখানা উৎপাদন করছে। দেশে এখন সিমেন্টের চাহিদার পরিমাণ ৩২ মিলিয়ন মেট্রিক টন, সেখানে বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে ৫৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ফলে এখন দেশের চাহিদা পূরণ করে সিমেন্ট রপ্তানি করাও সম্ভব। তবে এ জন্য সরকারের পলিসি সাপোর্ট প্রয়োজন। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য, মিয়ানমার ও নেপালে সিমেন্ট রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ আছে। তবে যোগাযোগ অবকাঠামোর অভাব ও নানা শুল্ক অশুল্ক বাধায় তা ধরা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্যের অবাধ যাতায়াত সম্ভব হলে বাংলাদেশের সিমেন্ট রপ্তানি বাড়তে পারে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা।
১৯৪১ সালে আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানি নামে দেশে প্রথম সিমেন্ট কারখানা স্থাপন হয় সিলেটের ছাতকে সুরমা নদীর তীরে। স্বাধীনতার পরে একমাত্র সিমেন্ট কারখানাটি বিসিআইসির অধীনে ছাতক সিমেন্ট নামে উৎপাদন অব্যাহত থাকে। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৩ সালে চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিঙ্কার এন্ড গ্রাইডিং ফ্যাক্টরি নামে আরেকটি কারখানা স্থাপন করা হয়। যা চট্টগ্রামের জন্য ছিল প্রথম কারখানা। বর্তমানে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করছে এ প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৯২ সালের দেশীয় উদোক্তাদের মালিকানায় দেশের প্রথম বেসরকারি খাতে বাগেরহাটের মোংলায় মেঘনা সিমেন্ট মিল স্থাপন করে বসুন্ধরা গ্রপ। এ মিলে উৎপাদিত কিং ব্রান্ড সিমেন্ট শুরুতে বেশ পরিচিত লাভ করে। পরে অন্য বড় উদোক্তারা এগিয়ে আসেন এ খাতে। এরপর থেকে গড়ে ওঠে বহু সিমেন্ট কারখানা। বিশেষ করে ১৯৯৫ সালের পর থেকে দেশীয় উদ্যোক্তাদের অনেকে এগিয়ে আসেন এ খাতে। এরপরই একে একে গড়ে ওঠতে থাকে সিমেন্ট কারখানা। এখন দেশের ভারী শিল্পের মধ্যে এ খাত বড় অংশ দখল করে আছে। উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি হচ্ছে দেশের সিমেন্টে। সাশ্রয় হচ্ছে কষ্টার্জিত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। তাছাড়া রপ্তানির মাধ্যমে উল্টো বৈদিশেক মুদ্রা আয়েরও নতুন পথ খুলেছে এ খাত ঘিরে।
সিমেন্ট রপ্তানিকারকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, প্রায় দেড় দশক আগে সিমেন্ট রপ্তানির দ্বার খুলেছিল। তবে পরবর্তী সময়ে সিমেন্ট রপ্তানি খুব একটা বাড়েনি। উত্তর পূর্ব ভারত ব্যতীত আরও কোথাও রপ্তানির তেমন বিশেষ সুযোগ নেই। উত্তর পূর্ব ভারতের সীমান্ত অবকাঠামো ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও উন্নতি হলে রপ্তানিকারকদের জন্য সহায়ক হবে। তবে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ, নেপাল ও ভুটানের অবকাঠামো উন্নতি হলে সিমেন্ট রপ্তানির সুযোগ বাড়বে। তাছাড়া সরকার যদি সিমেন্ট রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দেয় তাহলে রপ্তানিতে কিছুটা গতি আসার সম্ভাবনা আছে।
সিমেন্ট রপ্তানিকারকেরা জানান, নেপালে সিমেন্ট রপ্তানি করা যাচ্ছে না, কারণ বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের কাঁকরভিটা পর্যন্ত যেতে দুই দফা পণ্য ওঠাতে নামাতে হয়। বাংলাদেশের ট্রাক সরাসরি নেপাল যেতে না পারায় খরচ বেড়ে যায়। এদিকে মিয়ানমারে বেশি পরিমাণে সিমেন্ট পাঠানো যাচ্ছে না বলেও দাবি উদ্যোক্তাদের।
ব্যবসায়ীদের মতে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হওয়ায় সিমেন্ট খাতের বর্তমান অবস্থা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। তারমধ্যে বাজেটে ঘোষিত শুল্ক ও করকাঠামো সিমেন্ট শিল্পকে আরও বেকায়দায় ফেলেছে। বাজেটে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানিতে ৫ শতাংশ এবং সরবরাহ পর্যায়ে ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ধার্য করা হয়েছে। এ দুটি পর্যায়ে অগ্রিম আয়করই অফেরতযোগ্য। এই অসহনীয় করকাঠামো সিমেন্ট শিল্পের প্রসারের জন্য অন্তরায়। অন্যদিকে বিশ^ বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়লেও তীব্র প্রতিযোগতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সম্ভব হয় না। আবার চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ জটের কারণেও কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে সিমেন্ট শিল্পকে সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন। তারমধ্যে অন্যতম হলো কর কাঠামো আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া, গৃহঋণের সুদের হার কমানো, জমি ও এপার্টমেন্ট ক্রয়ে রেজিস্ট্রেশন খরচ কমানো এবং সিমেন্ট রপ্তানির ওপর নগদ সহায়তা প্রদান করা। সিমেন্ট খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশের সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ছাড়সহ বিশেষ সুবিধা দেয়া হলে এই খাতে রপ্তানি সম্ভাবনা অনেক। এর ফলে সিমেন্ট শিল্পের বিকাশ হবে। এ শিল্প বড় হলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এছাড়া সিমেন্ট রপ্তানি বাড়াতে প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। নগদ সহায়তা দিলে রপ্তানি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ আছে। এই দুই বাজারে জায়গা পেতেও প্রতিযোগিতা রয়েছে বেশ। এ জন্য প্রণোদনা দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলেও মত তাদের। বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্প অনেক পুরনো হলেও সম্প্রতি এ শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটছে। সরকার এ খাত থেকে প্রতি অর্থ বছরের প্রায় এক হাজার কেটি টাকা রাজস্ব পেয়ে থাকে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১৭ লাখ ১২ হাজার ডলারের সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে। এর আগের বছর তা ছিল ৩৯ লাখ ৪৪ হাজার ডলার। এসব সিমেন্ট মিয়ানমার, ভারত ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে রপ্তানি হয়েছে।
২০১৪-১৫ অর্থ বছরে বিদেশে সিমেন্ট রপ্তানি হয় ৪ দশমিক শূন্য ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সিমেন্ট। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ হতে ৫ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সিমেন্ট বিদেশে রপ্তানি করা হয়। রপ্তানির মধ্যে শুধুমাত্র প্রতিবেশী দেশ ভারতেই ক্রাউন সিমেন্ট সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে থাকে। তাছাড়া শাহ সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, আকিজ সিমেন্ট, সেভেন রিংস, আরামিট, কনফিডেন্স, ডায়মন্ড ও বাংলাদেশে উৎপাদিত আল্ট্রাটেকও আছে।
গেল দুই দশক ধরে বাংলাদেশে সিমেন্ট খাতে অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। এতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা আরও শাণিত হয়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালে জনপ্রতি মাত্র ৯৫ সিমেন্টের ব্যবহার হয়েছিল এবং ২০২০ সালে তার ২০০ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। গত বছর দেশে মোট ব্যবহার হয়েছে সোয়া তিন কোটি টন সিমেন্ট। বিপুল এ চাহিদার প্রায় পুরোটাই এককভাবে জোগান দিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো। যে অল্প কয়েকটি খাতে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং রপ্তানি করার ক্ষমতা রাখে, সেগুলোর মধ্যে সিমেন্ট শিল্প হচ্ছে অন্যতম।
সিমেন্ট শিল্পে আশাতীত অগ্রগতি সাধিত হওয়ার পেছনে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এই বিপ্লবের প্রধান কারিগর। আরও সুখবর হচ্ছে বাংলাদেশের সিমেন্ট এখন মানের ক্ষেত্রেও বিদেশি সিমেন্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা রাখে। বিশে^র বাজারও খোলা রয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন সরকারি নীতি ও সহযোগিতা। বাংলাদেশে সিমেন্টের মূল্য বিশ^বাজারের চেয়ে অনেক কম। এমনকি ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও কম। বাংলাদেশ চাইলে দুবাই, আফগানিস্তান ও ভারতের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় সিমেন্ট রপ্তানি করতে পারে। শুধু প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা। কার্বন নির্গমন প্রতিরোধ সম্পর্কিত কিওটো প্রটোকল স্বাক্ষর করায় ইতোমধ্যে চীনসহ অনেক দেশ শ্রমঘন শিল্পকারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তর শুরু করেছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট শিল্প কারখানার প্রসার ঘটানো সম্ভব। ফলে সিমেন্ট উৎপাদন শিল্পে বাংলাদেশ এশিয়ার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।

তথ্যসূত্র : সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ সিমেন্ট আয়রন এন্ড স্টিল মার্চেন্টস্ এসোসিয়েশনের প্রকাশিত সামায়িকী ও বিভিন্ন গণমাধ্যম

লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট