চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

ইস্পাত শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে গোল্ডেল ইস্পাত ও এইচএম স্টিল

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ৮:২১ অপরাহ্ণ

মোহাম্মদ সরওয়ার আলম

 

ইস্পাত বিশ্বের অন্যতম উদ্ভাবনী এবং আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।  একটি দেশের প্রগতিশীল অর্থনীতির উন্নয়ন দৃঢ় ভাবে নির্ভর করে যে কীভাবে সেই দেশের অবকাঠামো নির্মাণ সামগ্রীগুলো বিশেষত ইস্পাত সম্পর্কিত শিল্পগুলো বিকশিত হয়েছে এবং এ জাতীয় পণ্যের সহজলভ্যতা। ইস্পাত শিল্প কেবল অর্থনৈতিক বিকাশ গতিময় করে না। ভারী প্রকৌশল এবং নির্মাণের মতো অন্যান্য প্রশংসামূলক শিল্পেও একটি সুনির্দিষ্ট  মৌলিক ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে ইস্পাত উৎপাদন এবং ব্যবহারে রয়েছে একটি গর্বিত ঐতিহ্য।

শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশের অর্থনীতিতে উন্নয়ন এবং ইস্পাত ব্যবহারে বিকাশের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। যদি একটি দেশের জিডিপি ৮% বাড়তে পারে, সেক্ষেত্রে  ইস্পাত শিল্প প্রতি বছরে কমপক্ষে ১৬% বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্প-পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করে জাতীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ও জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক  অবদান রাখছে।

মোস্তফা হাকিম গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আব্দুল হাকিম মাইজভা-ারী ইস্পাত শিল্পের গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন ১৯৬০ সালে, যখন তিনি একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান  প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে তিনি নির্মাণশিল্পো জন্য নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদনে স্বপ্ন দেখতেন। বর্তমানে তার উত্তরসূরীরা  এই স্বপ্ন বহন করে চলেছেন। মোস্তফা হাকিম গ্রুপ ইস্পাতের চাহিদা এবং  এর সুদূরপ্রসারী ব্যবহারের কথা চিন্তা করে ১৯৮০ সালে  শিপ ব্রেকিং শিল্পে পদার্পন করে।  এবং  ১৯৮৫ সালে গোল্ডেন আইরন রি-রোলিং মিলস এবং ১৯৮৭ সালে গোল্ডেন স্টিল রি-রোলিং মিলস স্থাপন করে।  সেই সময় থেকে এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত  ম্যানুয়াল রড দেশে সমাদৃত। পণ্যের গুনগতমান  উন্নয়নে  নতুন প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়েছে বিগত কয়েক দশকে।  দীর্ঘ ৪০ বছরের রড উৎপাদনের অভিজ্ঞতা এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে মোস্তফা হাকিম গ্রুপ- ২০১৭ সালে চট্টগ্রামের সীতাকু-ে গোল্ডেন ইস্পাত লিমিটেড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে একটি যুগোপযোগী এবং আধুনিক রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে  স্বীকৃতি  অর্জন করে।

বর্তমানে মোস্তফা হাকিম  গ্রুপ  বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন  এবং পরিষেবা নিয়ে কাজ করে। যেমন : জাহাজ ভাঙ্গা, রড, সিমেন্ট ও ইট উৎপাদন,  অক্সিজেন, এলপিজি, টেক্সটাইল, রিয়েল এস্টেট, আমদানি ও রপ্তানি  ক্ষেত্রে তার গুণগত মান ও নির্ভরযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে এই গ্রুপের অধীনে প্রায় ৫০০০ কর্মী ১৫টি বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে  কাজ করছে ।

গোল্ডেন ইস্পাত লিমিটেড এবং এইচএম স্টিল এন্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড উভয়ই মোস্তফা হাকিম গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের অবকাঠমো উন্নয়নে ইস্পাত শিল্পের অবদানকারী হিসাবে, এই দুই প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস করে যে দেশে যুগোপযোগী উন্নয়ন  এবং আধুনিক নির্মাণের সর্বাধিক গুণগত মানের ইস্পাত প্রয়োজন। মোস্তফা হাকিম গ্রুপ কেবল সেরা মানের ইস্পাত উৎপাদন করছে না, সাথে সর্বোচ্চ মানের সিমেন্ট এবং ইট তৈরি করছে, তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মোস্তফা হাকিম গ্রুপ দেশের টেকসই নির্মাণকে ত্বরান্বিত করছে।

গত দশকের তুলনায় ইস্পাতের চাহিদা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দশকে মাত্র ২.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাহিদা থেকে বর্তমানে  ৭.৫-৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাহিদা দাঁড়িয়েছে। এবং ২০১২ সালে ইস্পাতের মাথাপিছু ব্যবহার ছিল মাত্র ২৫ কেজি – যা  ২০২২ সালে মধ্যে ৭৫ কেজি  হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমাদের দেশের  জিডিপি প্রবৃদ্ধি এখন ৭.৮৬% যা গত দশকেও ছিল ৬%. যার মধ্যে এই শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি  উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি।

এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং গ্রাহকের নিবিড় আস্তার কারণে মোস্তফা হাকিম গ্রুপ ২০২০ সালে এইচ.এম স্টিল এন্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড স্থাপন করে।  এইচ এম স্টিল এন্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড- ইস্পাত এবং অবকাঠামো খাতে একটি বিশ্বের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অনুপ্রেরণা ও সমন্বয়। যার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ও নেতৃত্বে আছেন আলহাজ মোহাম্মদ মনজুর আলম ( চেয়ারম্যান-এইচএম স্টিল এন্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ও  সাবেক মেয়র চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন)। এটি মোস্তফা হাকিম গ্রুপের  সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তির স্টিল প্ল্যান্ট। চার দশকেরও বেশি সময়ের ইস্পাত উৎপাদনের অভিজ্ঞতা, সততা, যুগোপযোগী উন্নয়নের অংশীদারিত্ব  এবং সর্বোপরি গ্রাহকের আস্থা  এইচ এম স্টিল প্রতিষ্ঠার প্রধান কারণ।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা ডাঙ্গারচর জুলদাতে ২৫ একর জমির উপর এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করা হয়। এটি একটি সমন্বিত সর্বাধুনিক প্ল্যান্ট। এই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য গুণগতমান আন্তর্জাতিক প্রযুক্তির সাথে আন্তর্জাতিক নির্ধারিত মান নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের বৃহত্তম ইস্পাত প্রস্তুতকারক এবং সেবা  প্রদানকারী হিসেবে এইচএম স্টিল সর্বদা অর্থনীতি, সমাজ এবং পরিবেশের উন্নয়নে সমন্বয় সাধনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু মাত্র রড উৎপাদনে সীমাবদ্ধ নয়, ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে  এই প্রতিষ্ঠানে  উৎপাদনে যুক্ত হবে এঙ্গেল, চ্যানেল, স্কোয়ার বার এবং ফ্ল্যাট  বার।

মোস্তফা হাকিম গ্রুপের এই দুইটি রড উৎপাদনকারী  প্রতিষ্ঠান  উৎপাদনে  বিশ্বমানের  অত্যাধুনিক  ডিএইচআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে। ডিএইচআর প্রযুক্তি হলো বিশ্বের স্টিল সেক্টরে উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তিগুলো মধ্যে একটি, যা এনার্জি সেভিং  এবং পরিবেশ-বান্ধব উৎপাদনে প্রতিনিধিত্ব করে।

বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ যেখানে নগণ্য প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। মোস্তফা হাকিম গ্রুপ প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার  স্বার্থে গোল্ডেন ইস্পাত এবং এইচ এম স্টিল প্ল্যান্ট-এ  বিলেট মেল্টিং এবং কাস্টিং প্ল্যান্টে বিশ্বমানের  উন্নত বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ (এপিসি) প্রযুক্তি সংযুক্ত করেছে। এপিসি  শক্তিশালী ডিভাইস দ্বারা ক্ষতিকারক কার্বন নির্গমন রোধ বায়ু ফিল্টারে পৌঁছে দেয়। ফিল্টারটি সমস্ত কঠিন স্থগিত কণাকে ধরে রাখে এবং শুধুমাত্র পরিষ্কার, ধুলোমুক্ত বায়ু বায়ুম-লে নির্গত করে ।

গোল্ডেন ইস্পাত লিমিটেডের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ২,৫০,০০০ মেট্রিক টন  এবং এইচ এম স্টিল এন্ড ইন্ডাস্ট্রি  লিমিটেড এর বার্ষিক  উৎপাদন সক্ষমতা ৪,৫০,০০০ মেট্রিক টন।  আল্লাহর অশেষ রহমতে গত বছর থেকে এই দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে মোট বার্ষিক ৭,০০,০০০ মেট্রিক টন রড উৎপাদন হচ্ছে।  এই ছাড়া এই দুইটি প্রতিষ্ঠানে রয়েছে নিজস্ব অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন  ইন্ডাকশন ফার্নেস  যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানদ- পূরণ করে সর্বোচ্চ গুনগতমানের বিলেট উৎপাদন ও  গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে উচ্চ মানের স্কয়ার বিলেট সরবরাহ দিয়ে থাকে ।

ভালোমানের রড উৎপাদনের পূর্বশর্ত হলো ভালো মানের কাঁচামাল। মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালনা পরিষদ এই নীতিতে বিশ্বাসী। মোস্তফা হাকিম গ্রুপের রয়েছে নিজস্ব ৮টি শিপইয়ার্ড, যেখান থেকে সর্বোৎকৃষ্ট কাঁচামাল বাছাই করে রড উৎপাদনে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া উন্নত বিশ্ব থেকে কাঁচামাল আমদানি করেও তা রড উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি ২২৩ কোটি টাকা ব্যয় বাংলাদেশের গত এক দশকের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জাহাজ ক্রয় করে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের আরেকটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান  এইচএম শিপ ব্রেকিং লিমিটেড। যার থেকে সর্বোকৃষ্ট কাঁচামাল সংগ্রহ করে রড উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে।

উৎপাদনের পর গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী রড সরবরাহের জন্য রয়েছে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা।  নদীমাতৃক এই দেশে নৌ-পথে বিভিন্ন প্রান্তে রড সরবরাহের  জন্য এইচএম এন্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড -এর রয়েছে নিজস্ব জেটি ব্যবস্থা। যার মাধ্যমে অল্প সময়ে অল্প খরচে নৌ -পথে রড সরবরাহ করা যাবে। এই জেটি ব্যবস্থাটি এইচএম স্টিলকে পণ্য পরিবহন ও সরবরাহে নতুন মাত্রা যোগ করেছে যা সাধারণত অন্যান্য ইস্পাত উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দেখা যায় না।

উৎপাদনের পর রডের গুণগত মান পরীক্ষার জন্য দুইটি প্রতিষ্ঠানে রয়েছে জার্মান প্রযুক্তির অত্যাধুনিক ল্যাব এবং দক্ষ প্রযুক্তিবিদ যেখানে রডের গুনগত মান পরীক্ষার পর  বাজারজাত করার জন্য নেয়া হয়।  গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী রড সরবরাহের জন্য রয়েছে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। নদীমাতৃক এই দেশে নৌ-পথে বিভিন্ন প্রান্তে রড  সরবরাহের  জন্য এইচএম এন্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড -এর  রয়েছে নিজস্ব জেটি ব্যবস্থা।  যার মাধ্যমে অল্প সময়ে অল্প খরচে নৌ -পথে রড সরবরাহ করা যাবে।  এই জেটি ব্যবস্থাটি এইচএম স্টিলকে পণ্য পরিবহন ও সরবরাহে নতুন মাত্রা যোগ করেছে যা সাধারণত অন্যান্য ইস্পাত উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দেখা যায় না।

মোস্তফা হাকিম গ্রুপের ব্যবসায়িক লক্ষ্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়া নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে  সমাজে বাস করা মানুয়ের জীবন মান উন্নয়ন, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার পূরণে কাজ করা। এই লক্ষ্যে গড়ে তোলা  হয়েছে আলহাজ মোস্তফা হাকিম ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন সমাজের মানুষের সেবা করার জন্য বিভিন্ন সমাজসেবা-মূলক কাজের সাথে জড়িত। ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৭৭টি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এই ফাউন্ডেশনের অধীনে কাজ করছে। এই ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পরিচালিত এক ডজন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ১৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী প্রতিদিন জ্ঞান অর্জন করছে। এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নানাভাবে প্রতিবছর সেবা পাচ্ছে লক্ষাধিক মানুষ।

লেখক: পরিচালক, মোস্তফা হাকিম গ্রুপ

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট