চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

ইস্পাতে সমৃদ্ধির পথে দেশ

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ২:৩৮ অপরাহ্ণ

মোহাম্মদ আলী

একটি দেশের উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণের মেরুদণ্ড স্টিল তথা এমএস রড। স্টিল ছাড়া ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মাথাপিছু স্টিল ব্যবহারের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয় সে দেশ কতটা উন্নত। স্বল্পোন্নত থেকে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের সমপর্যায়ে পৌঁছবে বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশের স্টিল শিল্পের বিকাশ হচ্ছে। অথচ স্টিল তৈরির মূল কাঁচামাল আয়রন ওর বাংলাদেশে নেই। এমনকি বিদেশ থেকে আয়রন ওর আমদানি করে এনেও উৎপাদন সম্ভব না। কারণ এ দেশে কোনো বøাস্ট ফার্নেস স্থাপিত হয়নি এবং সহসা বসানো সম্ভব নয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি স্টিল উৎপাদন ও ব্যবহারকারী দেশ চীন, আমেরিকা, জাপান, রাশিয়া ও ভারত এ টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রচুর স্টিল উৎপাদন করে। তাদের উৎপাদন খরচও কমিয়েছে। বাংলাদেশে মূলত ইনডাকশন ও ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসের মাধ্যমে স্টিল উৎপাদন হয়। এ প্রযুক্তিতে কোনো মিনারেল আয়রন ব্যবহার করা যায় না। তাই মেল্টিং স্ক্র্যাপ আমদানি করে বাংলাদেশে স্টিল তৈরি করতে হয়। মূলত নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে উন্নত প্রযুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে অর্থাৎ বৃহৎ সাইজের ইনডাকশন ও ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস এবং অটোমেটিক রি-রোলিং মিল স্থাপন শুরু করা হয়। এর মধ্য দিয়ে উন্নত ও বিশ্বমানের স্টিল উৎপাদনের সক্ষমতার দিকে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ।
দেশের শীর্ষ পর্যায়ের উদ্যোক্তারা বলছেন, ইস্পাতের ভবিষ্যৎ চাহিদার কথা মাথায় রেখে আগে থেকেই বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে উৎপাদনক্ষমতা। উৎপাদনের তালিকায় একের পর এক যুক্ত হচ্ছে নতুন ও উচ্চশক্তির বিশেষায়িত রড।
ইস্পাতপণ্য প্রস্তুতকারক সমিতি ও উদ্যোক্তাদের তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগেও দেশে বছরে সম্মিলিতভাবে এমএস রড উৎপাদন হতো ২৫ লাখ টন। বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী বছরে গড়ে উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে প্রায় ৬০ লাখ টন। যদিও বর্তমানে কয়েকটি স্টিল তৈরি প্রতিষ্ঠানের কারখানা সম্প্রসারণ পদক্ষেপে ইস্পাতের (রড) সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা এখন ৯০ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। কারখানার সক্ষমতা যে গতিতে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে তাতে আগামী দুই বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালে এক কোটি টনে উন্নীত হবে। আর তখন এমএস রড উৎপাদন বছরে গড়ে ৭০ লাখ টন ছাড়াবে। এ খাতে উদ্যোক্তাদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় তিন লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। গত কয়েক বছর সরকারি খাতে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও প্রবাসী আয়ে গ্রামে পাকা ঘর নির্মাণ বাড়তে থাকাই ইস্পাত খাতের প্রবৃদ্ধির মূল কারণ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক প্রযুক্তি আর কারখানা সম্প্রসারণ করে উৎপাদন বাড়ানোয় মনোযোগ উদ্যোক্তাদের।
উচ্চবিনিয়োগের ব্যয়বহুল একটি খাত ইস্পাত শিল্প। একটা দেশের উন্নয়ন বিবেচনা করা হয় সে দেশের মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহার কত সেটা গণনা করে। বাংলাদেশে বর্তমানে মাথাপিছু স্টিল ব্যবহারের গড় হিসাব করা হয় ৪৫ কেজি। অর্থনীতির পরিধি বড় হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ করে সরকারিভাবে অবকাঠামোগত যে উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে আগামী দুই বছরে এ চাহিদা বেড়ে ৭০ কেজি ছাড়িয়ে যাবে। দেশে মূলত লৌহ শিল্পের প্রবৃদ্ধি ঘটছে ১৯৯০ সালের পর থেকে। নব্বই দশকে খাতটিতে একে একে বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন উদ্যোক্তারা। তখন রডের কাঁচামাল সহজলভ্য করে জাহাজ ভাঙার পুরনো লোহা। শুরুর তিন দশক সনাতন পদ্ধতিতে থাকলেও পণ্যে বৈচিত্র্য আর উৎপাদনে রূপান্তর ঘটিয়ে মূলত ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ওপর ভর করে ক্রমাগত সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের ইস্পাত খাত।
বাংলাদেশে ইস্পাত খাতে যাত্রা শুরুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিএসআরএম গ্রুপের নাম। প্রায় ৭১ বছর আগে ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালার তিন ভাই ‘ইস্ট বেঙ্গল স্টিল রি-রোলিং মিলস’ গড়ে তোলেন। স্বাধীনতার পরে নাম বদলে হয় বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস বা বিএসআরএম। এটিই প্রথম প্রজন্মের কারখানা। দীর্ঘ সময় ধরে শুধু একটি খাতেই ব্যবসা করছে কোম্পানিটি।
অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এখন ব্যক্তি খাতনির্ভর। অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। আলীহোসাইন আকবরআলী, তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের ইস্পাতশিল্পের গুরু। বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলের (বিএসআরএম) চেয়ারম্যান। এ দেশের লৌহ ও ইস্পাতশিল্পের যুগান্তকারী সব পরিবর্তনই এসেছে তাঁর হাত ধরেই।
প্রায় ৬৬ বছরের পুরোনো চট্টগ্রামের আবুল খায়ের গ্রুপ ফ্ল্যাট স্টিল বা ঢেউটিন উৎপাদনের মাধ্যমে ইস্পাত খাতে যুক্ত হয় ১৯৯৩ সালে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে মাদামবিবিরহাটে গ্রুপটির ঢেউটিন কারখানা রয়েছে। গ্রুপটি ২০১০ সালে সীতাকুণ্ডের শীতলপুরের কারখানায় বাংলাদেশে প্রথম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে ইস্পাত উৎপাদন শুরু করে।
ইস্পাত খাতে দ্বিতীয় প্রজন্মের কারখানা কেএসআরএম। ১৯৮৪ সাল থেকে ইস্পাত পণ্য রড উৎপাদন করে আসছে কোম্পানিটি। ইস্পাত খাতের বাজারে তৃতীয় অবস্থানে থাকা এই গ্রুপ উচ্চশক্তির নতুন পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছে বাজারে।
নগরীর নাসিরাবাদে ১৯৮৬ সালে উদ্যোক্তা আবু বকর চৌধুরীর হাত ধরে যাত্রা করে বায়েজিদ স্টিল। রড উৎপাদনের ক্ষেত্রে ২০১০ সালে বেলজিয়ামের টেমকোর প্রযুক্তি ব্যবহার হয় কারখানাটিতে। প্রতিষ্ঠানটির রড তৈরির কারখানার পাশাপাশি রয়েছে বিলেট কারখানা।
এদিকে চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারা শিপ ব্রেকিং, শিপ বিল্ডিং ও ইস্পাতপণ্য নির্মাণে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। গত এক দশকে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সমন্বয় করে ইস্পাতপণ্যের চাহিদাও বেড়েছে কয়েক গুণ। দেশের মেগা প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম চলমান থাকায় আগামীতে রডসহ বিভিন্ন ইস্পাতপণ্যের চাহিদাও বেড়ে দ্বিগুণ হবে। সুদূরপ্রসারী জায়গা থেকে চিন্তা করে চট্টগ্রামের শীর্ষ ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তারা এরই মধ্যে তাদের উৎপাদন দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রথম সারির নেতৃস্থানীয় ইস্পাত কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন খাতে ব্যবসায় থাকা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ইস্পাত খাতে বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসছেন। এরই মধ্যে চট্টগ্রামের বনেদি বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী পরিবার এ খাতে বিনিয়োগ করেছে। কেউ কেউ বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশীয় চাহিদা মেটানো ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশেও ইস্পাতপণ্য রফতানির সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
খাতভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামের অধিকাংশ ইস্পাতপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে। নিজেদের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের স্ক্যাপ ব্যবহার করে রড প্রস্তুত করা ছাড়াও চাহিদা মেটাতে বিশ্ববাজার থেকেও স্ক্র্যাপ আমদানি করতে হচ্ছে। স্ক্র্যাপের মাধ্যমে বিলেট উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্ববাজার থেকে ফিনিশড পণ্য আমদানিনির্ভরতাও কমিয়ে এনেছেন চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারা। কাঁচামাল থেকে বিলেট উৎপাদনের মাধ্যমে দেশীয় চাহিদা পূরণ ছাড়াও বিশ্ববাজারে বিলেট রফতানির বড় সম্ভাবনা জাগিয়েছেন চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারা।
ভৌগোলিক সুবিধা যেমন দেশের প্রধানতম বন্দর (চট্টগ্রাম বন্দর), শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডসহ নানাবিধ কারণে এখানেই ইস্পাতপণ্য উৎপাদন সুবিধাজনক। যার কারণে কাঁচামাল আমদানি, বন্দর দিয়ে সারাদেশে উৎপাদিত পণ্য পরিবহন, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে কাঁচামাল সংগ্রহসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সর্বাপেক্ষা সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি করা সহজ চট্টগ্রাম থেকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রি-রোলিং মিল স্থাপনের চেষ্টা করলেও চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের ভৌগোলিক সুবিধাকে এড়িয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে কলেবর বাড়াতে সক্ষম হয়নি। যার পুরো সুবিধাটাই নিয়েছেন চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারা।
এদিকে চার দশক ধরে ইস্পাতপণ্য উৎপাদন ও বিপণনে দক্ষতা তৈরি করেছে মোস্তফা হাকিম গ্রুপ। ইস্পাতের বাজারে ইতোমধ্যে ব্যবসাও স¤প্রসারণ করে নিয়েছে গ্রুপটির দুই সহযোগী প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন ইস্পাত লিমিটেড ও এইচএম স্টিল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। গোল্ডেন ইস্পাত লিমিটেডের ইস্পাত উৎপাদনে সক্ষমতা ছিল বার্ষিক আড়াই লাখ টন। তবে চলতি বছর থেকে মোস্তফা হাকিম গ্রুপেরই আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান এইচএম স্টিলের মাধ্যমে উৎপাদন সক্ষমতা বার্ষিক সাত লাখ টনে উন্নীত করা হয়েছে। চলমান মেগা প্রকল্পসহ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণে মানসম্পন্ন রড সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ প্রসঙ্গে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম বলেন, ‘আমরা সবসময়ই গুণগত মান, সঠিক ওজন ও সঠিক সময়ের মূল্যবান গ্রাহকের কাছে পণ্য সরবরাহের ধারাবাহিকতা বজায় রাখি। আমাদের উৎপাদিত দুটি ব্র্যান্ড এ দেশের মানুষের নিরবচ্ছিন্ন আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে এ খাতে ব্যবসা সপ্রসারণ করে নিতে হয়েছে। কাঁচামালের সহজলভ্যতা, বন্দরের সুবিধা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সহজলভ্যতা, ব্যবসায় করবান্ধব নীতিমালা প্রভৃতির সমন্বয় এ শিল্পের বিকাশকে ত্বরান্বিত করবে।’

লেখক : রিপোর্টার, দৈনিক পূর্বকোণ

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট