চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

করোনাতে বেড়েছে মোটরসাইকেল বিক্রি

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ১:৫৩ অপরাহ্ণ

করোনা মহামারী সংকটে জীবন জীবিকার সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যেও স্থবিরতা নেমে এসেছিল। দফায় দফায় লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়েন অনেকে। তবে লকডাউনের বিভীষিকার মাঝে উল্টো পথে হেঁটেছে দেশের মোটরসাইকেল বিক্রির বাজার। আমদানি জটিলতা আর লকডাউনের কড়াকড়ির আরোপের কারণে মোটর সাইকেল সরবরাহ রীতিমতো ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। মোটরসাইকেল সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের চেয়ে চলতি বছরে ২৫ শতাংশ মোটরসাইকেল বিক্রি বেড়েছে। দিন দিন মানুষের চাহিদা ও আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় এটিকে সম্ভাবনায় খাত হিসেবেও দেখছেন তারা। নগরীর আগ্রাবাদে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তাসমিয়া আক্তার। পরিবারসহ থাকেন মুরাদপুরের সুন্নিয়া মাদ্রাসার পাশে। সকালে সন্তানদের নাস্তা আর স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার পর তাকে ছুটতে হয় অফিসের উদ্দেশ্য। তবে সড়কে অসহনীয় যানজটের কারণে বাধে বিপত্তি। প্রায় সময় অফিসে পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছিল তাসমিয়ার, সে সঙ্গে রয়েছে নানা ভোগান্তি। উপায় না পেয়ে যাতায়াতের জন্য নিজের তুলে রাখা জমানো টাকায় স্কুটি ( মোটর সাইকেল) কেনার সিদ্ধান্ত নেন তাসমিয়া। সেখানেও বাধ সাধে শ্বশুর-শাশুড়ি। শেষমেষ ব্যক্তিগত যানবাহন খুঁজে নিতে মুরাদপুরে মোটরসাইকেলের শো রুমে আসেন স্বামীসহ। কষ্টের টাকায় পছন্দসই ও আরাদায়ক স্কুটি নিতে শো রুম ঘুরে পরখ করছিলেন। সেখানে তাসমিয়ার স্কুটি কেনার পেছনের কথা উঠে আসে। তিনি বলেন, সকালে পারিবারিক ব্যস্ততা শেষ করে অফিসে যেতে দেরি হচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম স্কুটি নেবো। কিন্তু বাড়ির বউ স্কুটি চালাবে এটা মেনে পারছিলেন না শাশুড়ি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চাকরিটা ছেড়ে দিব। আমার স্বামী সার্পোট দিয়েছেন। নিজের জমানো টাকা দিয়েই কিস্তিতে স্কুটি কিনব ভাবছি। দর দাম দেখতে এসেছি। পছন্দ হলেই সামনের মাসের বেতন মিলিয়ে একটা নিয়ে নিব। দ্রুত এবং ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াই আরামদায়ক উপায়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে তাসমিয়ার মতো অনেক কর্মজীবী নারী ও পুরুষ ঝুকছেন স্কুটি ব্যবহারে। করোনা মহামারীর প্রেক্ষিতে গণপরিবহন এড়িয়ে মানুষ মোটরসাইকেল কিনছেন বলে জানালেন বিক্রেতারা। এর মধ্যে তরুণ-তরুণীদের আগ্রহ সর্বাধিক।
মুরাদপুরে চাইনিজ মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড লিফনের একটি শো রুমে ইয়ামা, লিফন ও সুজুকি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের মধ্যে স্কুটি বিক্রি অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো বলে জানালেন এক বিক্রয়কর্মী। এখানে ১৬৫ সিসির দ্রুতগতি সম্পন্ন মোটরসাইকেল ও স্কুটি পাচ্ছেন ক্রেতারা। ক্রেতাদের চাহিদা বিবেচনায় ইয়ামা, সুজুকি ব্র্যান্ডের স্কুটি কিনতে সর্বনিম্ন ২ লাখ ৩৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকার মোটরসাইকেল রয়েছে। ১৬৫ সিসির মোটরসাইকেল কিনতে ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা গুনতে হবে। এছাড়া গতি ও ইঞ্জিনের ওপর নির্ভর করে সর্বনি¤œ ১ লাখ ১৫ হাজার টাকায় মোটরসাইকলে কেনার সুযোগ রয়েছে শোর রুমটিতে।
লিফন ব্র্যান্ডের পরিবেশক লোকমান হোসেন বলেন, একটা সময়ে মেয়েরা স্কুটি ব্যবহার করলেও ছেলেরাও আরামদায়ক ভেবে স্কুটির ব্যবহার করছে।
আমাদের শো রুমে সর্বোচ্চ ১৬৫ সিসির দ্রতগতির মোটরসাইকেল রয়েছে। গত কয়েক মাসের তুলনায় বিক্রিও বেশি। সামনের আরও বাড়বে। তরুণ-তরুণীদের কাছে ইয়ামা, সুজুকির কদর বেশি। এসব ব্র্যান্ডের ইঞ্জিন, বডি, পিকআপ ক্ষমতা বেশি বলে সবাই আগ্রহ দেখান।
চট্টগ্রামে ইয়ামা ব্র্যান্ডের নিজস্ব কোনো শো রুম না থাকলেও মুরাদপুর, আগ্রাবাদ এবং হালিশহরে কয়েকটি পরিবেশক পয়েন্ট রয়েছে। আগ্রাবাদে চৌমুনীতে ইয়ামাহার মোটরসাইকেল পরিবেশক পয়েন্টের স্বত্বাধিকারী কাজী মহিউদ্দীন মামুন বলেন, লকডাউনেও ব্যবসা ভালো ছিল। মোটরসাইকেলের চাহিদা সামনে আরও বাড়বে। আমদানি জটিলতার কারণে ঠিকমতো সরবরাহ দিতে পারিনি। প্রশিক্ষণের সুবিধা, ব্যক্তিগত গাড়ির চাহিদার মেটাতে মানুষ মোটরসাইকেল কেনায় আগ্রহী। বর্তমানে ১৫০ সিসির ২ লাখ ৩০ হাজার এফ কেড ভার্সন দুই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। মাসে বিভিন্ন মডেলের ৫০ থেকে ৭০ টির বেশি মোটরসাইকলে বিক্রি হয় বলে জানালেন মামুন।
নগরের মুরাদুপর এলাকায় ভারতীয় টিভিএস ব্র্যান্ডের নিজস্ব শো রুম ছাড়াও আগ্রাবাদ ও হালিশহরে পরিবেশক পয়েন্ট রয়েছে। সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামেও ভারতের মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিরো ব্র্যান্ড সমান জনপ্রিয়।
নিটল-নিলয় গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানটির মুরাদপুরে নিজস্ব শো রয়েছে। এছাড়াও নগরীর আগ্রাবাদে দুটি পরিবেশক পয়েন্ট রয়েছে । দুটি পরিবেশক পয়েন্ট এবং শো রুম মিলে মাসে তিনশোটি মোটরসাইকলে বিক্রির বাজার রয়েছে বলে জানালেন শো রুমের ইনচার্জ মোহাম্মদ মোসলে উদ্দীন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের যে চাহিদা গড়ে উঠছে এটি দিন দিন বাড়ছে। এটাকে সম্ভাবনায় খাত বলা যেতে পারে। সড়কের অবকাঠামো যত ভালো হবে ততই এই খাত প্রসিদ্ধ লাভ করবে। একটা সময় মানুষ দুই চাকার মোটরসাইকেল কিনতে ভয় পেতো, ঝুঁকির বিষয়টি চিন্তা করতো। এই চিন্তা অনেক অর্থে পরিবর্তন হয়েছে। করোনার সময়ও মানুষ মোটরসাইকেল কিনে সাড়া দিয়েছেন। স্বাচ্ছন্দ্য এবং যানজটের ঝক্কি ঝামেলা এড়াতে কার থাকার পরও একজন মানুষ মোটরসাইকেল কিনছেন। দ্রুত গতির চেয়ে আরামদায়ক বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। আমরাও গ্রাহকদের সেবা ও সার্ভিসকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। যা অন্যান্য অনেক ব্র্যান্ড থেকে আলাদা।
মোসলেম উদ্দিন বলেন, দেখতে সুন্দর, আরামদায়ক এবং সার্ভিস ভালো হওয়ায় ভারতের মতো বাংলাদেশেও সবাই হিরো ব্র্যান্ড পছন্দ করেন। বিভিন্ন সময়ে ডিসকাউন্ট সুবিধা ছাড়াও পাঁচ বছর পর্যন্ত একটি মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনের গ্যারান্টি সুবিধা দিয়ে আসছি। বর্তমানে হিরো হোন্ডায় ক্রেতার পছন্দ এবং সামর্থ অনুযায়ী ১০০ সিসি থেকে ১৬০ সিসির বিভিন্ন মডেলের মোটরসাইকেল কেনার সুযোগ রয়েছে। সর্বনিম্ন এইচ এফ ডুলেক্স-ক্যাস্ট সেল্ফ মডেলের ১০০ সিসির মোটরসাইকলে কিনতে ৯৫ হাজার টাকা পড়বে। এছাড়া সর্বোচ্চ ১৬০ সিসির থ্রিলার ডিডি মডেলের মোটরসাইকেল দাম পড়বে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯০ টাকা। এছাড়া হোন্ডা কোম্পানির স্কুটি বাইক এক লাখ ১০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। ১৫০ সিসির এডিভি মডেলের স্কুটির মূল্য পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকা, হোন্ডা পিসিএক্স ১৫০ সিসির পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকার মধ্যেই পাওয়া যাবে। হোন্ডা ব্র্যান্ডের এই দুইটি স্কুটি বর্তমান বাজারের শীর্ষস্থানে দখল করে আসে। তেল সাশ্রয়ের দিক মাথায় রেখে হিরো ছাড়াও ভারতীয় বাজাজ, মাহিন্দ্রা, টিভিএস কিংবা জাপানের সুজুকির বিভিন্ন মডেলের এবং মোটরসাইকেল চাহিদা সর্বাধিক। এক্ষেত্রে সিসি, ইঞ্জিন সুবিধা এবং বডির বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে এসব ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের কদর আগে চেয়ে বেশি। মোটরসাইকেলের বাজার বিদেশিদের দখলে থাকলেও দেশীয় ব্র্যান্ডের মধ্যে জৌলুস ছড়িয়েছে রানার। ক্রেতাদের সাড়া পেয়ে লকডাউনের সময় তাদের মোটরসাইকল বিক্রি করতে হয়েছে। অনলাইনে পেমেন্টের পর গ্রাহকের বাসায় মোটরসাইকেল পৌঁছে দেওয়া ব্যবস্থা করেছে কোম্পানাটি। এছাড়া ছয় মাস থেকে শুরু করে ২ বছর ৪ মাসের বেশি সময় পর্যন্ত কিস্তির আওতায় মোটরসাইকেল কেনার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে নগরীর দামপাড়ায় ও হাটহাজারীতে রানারের নিজস্ব শো রুম রয়েছে। হালিশহরের একটি পরিবেশক পয়েন্ট রয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি পরিবেশক পয়েন্ট দেওয়ার কথা ভাবছে রানার। গত বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ বিক্রি বেড়েছে বলে জানালেন রানার চট্টগ্রাম শো রুমের সহযোগী ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
গত বছরে ৫০ থেকে ৫৫ টির বেশি মডেলের মোটরসাইকলে বিক্রি হলেও এখন ৬০ টির বেশি মোটরসাইকেল বিক্রির চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। স্কুটির মধ্যে ১১০ সিসির এসকেওওট্রিডবিøউ মডেলের ও ১৬৫ সিসির বোল্ড সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। এসকেওওট্রিডবিøউ মডেলের জন্য দাম পড়বে ১ লাখ ১ হাজার এবং বোল্ড মডেলের দাম রাখা হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অল্প সময়ের মধ্যে রানার বিভিন্ন সিসির ৩০টি মডেল বাজারজাত করেছে। ব্যবসা সম্প্রসারণে মার্কেটে শেয়ার আছে প্রতিষ্ঠানটির। সর্বসিম্ন ৮০ সিসির মোটরসাইকেলের মধ্যে কিনতে গ্রাহকের ৮৫ হাজার এবং ১৬৫ সিসি মডেলের মোটরসাইকেল কিনতে গুনতে হবে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এছাড়াও ১১০ সিসির মোটরসাইকেল কিনতে ৮৬ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দিতে হবে। গ্রাহকদের সমর্থন পেলে রানার সামনেও আরও ভালো কিছু দেওয়া প্রতিশ্রতি দেওয়ার কথা জানিয়ে তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা ভেবেছিলাম পিছিয়ে গিয়েছি। কিন্তু সবার সহযোগিতায় দিন দিন আমরা বহুদূর এগিয়ে গিয়েছি। ঢাকার পরও চট্টগ্রামে স্কুটির সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেল বিক্রি ধুম পড়েছে। মাসের ৭০ শতাংশ বিক্রি বেড়েছে স্কুটিতে। এর মধ্যে ১০০টি স্কুটির বিক্রির মধ্যে ৯০ শতাংশ ক্রেতাই ছেলে। বাকি ১০ শতাংশ কিনেছে মেয়েরা। ডিসকাউন্ট সুবিধার আওতায় সর্বনিম্ন ৯৯ হাজারা টাকায় এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ ৭৭ হাজার টাকায় স্কুটির কেনার সুবিধা দিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, ঢাকায় তরুণীদের মধ্যে স্কুটির চাহিদা থাকলেও চট্টগ্রামেও আস্তে আস্তে এটি বাড়ছে। গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে লকডাউনেও শো রুম খুলে বিক্রি করতে হয়েছে। মোটর সাইকেল বাহনের বিভিন্ন অ্যাপস সার্ভিস এবং অনলাইন ব্যবসার প্রসারের কারণে দ্রুত মোটরসাইকেল বিক্রি বেড়েছে। এদিকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশের বাজারে ইলেকট্রিক মোটরসাইকেলের এক প্রকারের ক্রেতা সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুতের চার্জের সহায়তায় পরিবেশ বান্ধব এসব ই-বাইক ফুল চার্জে ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার যাওয়ার সুযোগ থাকছে। চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে গড়ে উঠছে বেশ কিছু স্কুটির শো রুম। দেড় মাস আগে নগরীর মুরাদপুরে স্কুটার গ্যালারি নামে ইলেকট্রিক মোটরসাইকেল শো রুম খোলা হয়েছে। দেড় মাসে চাহিদা অনুযায়ী বিক্রি না হলেও ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে বলে জানালেন স্কুটার গ্যালারির ম্যানেজার সাঈদ হোসেন সানি। তিনি বলেন, অন্য একটি ব্যবসায় লোকসানের পর প্রতিষ্ঠান খুলেছি। গ্রিন টাইগার ও একপ্লোয়েড নামে দুটি মোটরসাইকেলের কদর বেশি। সর্বসিম্ন ৭৫ থেকে ৮৫ হাজার টাকা পড়বে মোটরসাইকেল ও স্কুটারে খরচ পড়বে ১ লাখ টাকা। অপরদিকে অভি মোটরস নামে আরকেটি ই-বাইক শো-রুমে মাসে সাত লাখ টাকার মোটরসাইকেল বিক্রির বাজার রয়েছে বলে জানালে প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারী।

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট