চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সুনিপুণ হাতে নির্মাণ হচ্ছে এসি-নন এসি বাস ট্রাকের বডি

নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ৩:৪৩ অপরাহ্ণ

দম ফেলার সুযোগ নেই কারও। কেউ ইস্পাত খণ্ড কাটছেন, কেউ টায়ার খুলছেন। কেউবা রঙের প্রলেপ আর ওয়েল্ডিং মেশিন দিয়ে বাসের জোড়া লাগাচ্ছেন। কেউবা কাজ শেষে জোড়া লাগানো অংশ পরখ করে নিচ্ছেন। চেসিসের উপর ইঞ্জিন বসিয়ে বাস কিংবা ট্রাকের পুরো বডিটাই নির্মাণ করার মত গ্যারেজ চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। চট্টগ্রামে এই ধরনের গ্যারেজের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। কোন কোন গ্যারেজে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল বাসের বডিও নির্মাণ করা হয়।

সিটি গেইট, ফৌজদারহাট, বহদ্দারহাট এক কিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন গ্যারেজ ঘুরে দেখা গেছে, ছোট থেকে মাঝারি, চুক্তি এবং অর্থের ওপর নির্ভর করে গ্যারেজে বাসের বডি নির্মাণ এবং মেরামতের কাজ চলছে। শ্রমিকদের মজুরিসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সরবরাহ গ্যারেজ থেকে দেওয়া হলে এক ধরনের খরচ পড়ে। কেবল মজুরি দিয়ে গাড়ির বডি নির্মাণ কিংবা মেরামত করা হলে আরেক ধরনের খরচ বহন করতে হয়। তবে লোকসান এড়াতে যন্ত্রপাতির সরবরাহ ছাড়াই মেরামতের চুক্তি করেন মালিকরা।

কারণ ইদানিং গাড়ির বডি নির্মাণ সামগ্রির দাম ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। টাকা অগ্রিম প্রদান করা হলে দূরপাল্লার ৩৬ আসনের একটি বাসের বডি নির্মাণে এক মাস লাগে। এই কাজে ইঞ্জিন, রঙের, গদি বা আসনের, ওয়ারিং মেশিন, সেলনজার, লেদ মেশিন ওয়ার্কসপ, ফাইভার বক্স তৈরি, পাতি (সহকারী) মিস্ত্রি থেকে শুরু করে দশ ধরনের শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। এসব শ্রমিকদের এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা মজুরি দিতে হয়। এর মধ্যে দুই থেকে তিন জন শ্রমিক রঙের প্রলেপের কাজ করলে মাসে ৫০ হাজার টাকা, গদি বা আসন তৈরিতে দুই থেকে তিন জন শ্রমিকের ১০ দিন সময় লাগে। মজুরি দিতে হয় ১৮ থেকে ২৫ থেকে হাজার টাকা, গাড়ির লাইট, ফ্যানসহ ওয়ারিং মেশিনের কাজ করতে দুই থেকে তিন জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এতে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। এছাড়া বাসের পেছনের, সামনের এবং দুই সাইডে গ্লাস ফিটিংয়ে কাজ করা শ্রমিকদের ১৫ হাজার টাকা মজুরি দিতে হয়। কাজের ধরন অনুযায়ী প্রধান শ্রমিকের ৯০০ টাকা এবং সহযোগীর  ৫০০ টাকা মজুরি পড়ে।

বড় বাসে এসির সুব্যবস্থা করতে ৩৭ থেকে ৩৮ লাখ টাকা এবং নন এসি হলে ১৪ থেকে ১৭ লাখ টাকা খরচ পড়ে। অপরদিকে ছোট আকারের গণপরিবহনগুলো মেরামতে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ পড়ে। মেরামত করতে প্রয়োজন পড়ে  ১২ থেকে ২২ দিন।

পণ্যবোঝাই ছোট থেকে মাঝারি ট্রাকের বডি নির্মাণ করতে শ্রমিকদের ১৫ থেকে ১৭ দিন লাগে। এক্ষেত্রে ডেন্টিং, পেইন্টিং, ওয়ারিং মেশিন, ইলেকট্রিক ম্যাকানিক, সিটের গদি বা আসনের কাজ করেন শ্রমিকরা ।

নগরের সিটি গেইটের গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের ফৌজদারহাট শাখা ধরে সামনেই এগোতেই চোখে পড়বে বাস-ট্রাকের বডি নির্মাণ এবং মেরামতের গ্যারেজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী পরিবহনগুলোর অনেক বাস এখানে মেরামত করা হয়। এমনই একটি গ্যারেজের সামনে বাঁধন পরিবহনের একটি বাসের কাজ করছিলেন দু’জন শ্রমিক। বাসটির সামনের ও পেছনের অংশে কোনা গ্লাস নেই। সামনের ভাঙা অংশে মেরামতের কাজ করছিলেন মো. ইফতেখার উদ্দীন ফারুক। তাকে যন্ত্রাংশ এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করছিলেন আরেক শ্রমিক সুমন।

জানতে চাইলে ফারুক বলেন, নতুন গাড়ি চারটা ট্রিপ দেয়ার পর লরির পেছনে ধাক্কা লাগায় দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। পেছনের বডির কাজ করতে হচ্ছে। গাড়ি মালিকের দেড় লাখ টাকা খরচ পড়ছে।  আড়াই বছর আগে ঢাকায় গাড়ি মেরামতের কাজে হাতেখড়ি ফারুকের। ঢাকা ও ফেনীতে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা শেষে সাত বছর আগে পা রাখেন চট্টগ্রামে। তার বাড়ি নোয়াখালীর বসুরহাটে। সাত বছর ধরে কাজ করে চলেছেন ভাই ভাই মোটরসে। সহকারী হিসেবে কাজ শুরুর পর এখন সে হেড মিস্ত্রী।  মাসে বেতন ২২ হাজার টাকা। এই গ্যারেজে কাজ করেন সাত শ্রমিক।

পাশের আরেকটি গ্যারেজে দেখা গেল নিবিষ্ট মনে এক শ্রমিক একটি স্কুল বাসের ছাদের রডের খুঁটি বসাচ্ছেন। ৫৫ সিটের গাড়িটি মেরামতের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে গুনতে হবে ১২ লাখ টাকা। ব্যবসার হালচাল নিয়ে কথা হয় গ্যারেজের ম্যানেজার তৈয়ব উল্লাহ সঙ্গে। তিন বছর ধরে তিনি প্রতিষ্ঠানটি দেখভাল করছেন। বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়ে কথা উঠতেই তিনি হতাশার সুরে বলেন, সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। গাড়ি মেরামতের প্রতিটি যন্ত্রাংশের দাম অন্যান্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। পরিবহনের সঙ্গে গ্যারেজের সংখ্যাও বেড়েছে। একজন হেড মিস্ত্রিকে দৈনিক ১ হাজার টাকা, তার সহযোগীকে ৪০০ টাকা মজুরি দিতে হয়। গ্যারেজ ভাড়া পরিশোধ করতে হয় ৩০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে গ্যারেজের পিয়ন, বিদ্যুৎ বিল মিলে দিয়ে পোষাচ্ছে না। লকডাউনের কারণে গাড়ির অনেক যন্ত্রাংশ গ্যারেজে নষ্ট হয়ে গেছে, ভালো শ্রমিকরা বেকার হওয়ার ভয়ে চলে গেছে। গ্যারেজ বন্ধ থাকায় মালিকরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। দূর পাল্লার গাড়ির মালিকরাও পরিবহনের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে।

জীবিকার তাগিদে এই পেশায় শিশু থেকে বিভিন্ন বয়সীর মানুষের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। তাদের সুনিপুণ হাতে ভাঙাচোরা, লক্কর-ঝক্কর গাড়ি নতুন হয়ে যাচ্ছে। আকবর শাহ এলাকা থেকে লতিফপুর পাকা রাস্তা মাথা পর্যন্ত অর্ধশত গাড়ি, পিকআপ, ট্রাকের গ্যারেজ রয়েছে। এমন একটি গ্যারেজে দুই মাস আগে কাজ শিখতে এসেছে আট বছর বয়সী মো. তামিম। করছে ভারী লোহার যন্ত্র আনা নেওয়ার কাজ। গায়ে মবিলের দাগ। মুখে ক্লান্তির ছাপ। তামিমের বাড়ি গ্যারেজের কাছেই। বাবা নেই, আছে দুই বোন। মাসে দুই হাজার টাকা মজুরি পায়। প্রশ্নের জবাবে সে জানায়, ‘কাজ শিখতে এসেছি।’ চট্টগ্রামে পরিবহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নগরের বহদ্দারহাট এলাকার এক কিলোমিটার এলাকায় গড়ে উঠেছে গাড়ির শতাধিক গ্যারেজ। সকাল নয়টায় শুরু হয়ে রাত এগারোটা পর্যন্ত গাড়ির চালক, সহকারী ও শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞে সরগরম থাকে এসব গ্যারেজ। এসব গ্যারেজের কল্যাণেই ফিটনেসরবিহীন, লক্কর ঝক্কর গাড়িগুলো নতুনের মতো হয়ে উঠে। মেরামতের পর সড়কে দাপিয়ে বেড়ায়। রঙের প্রলেপ আর আরামদায়ক আসনে নতুন রূপে সাজিয়ে যাত্রীদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু মেরামতের পর এসব গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার কোনো জো থাকে না। ফলে সড়কে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা।

জানতে চাইলে সিটি গেইট এলাকার হীরা মোটর্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ শাহ আলম পূর্বকোণকে জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে গাড়ির বডি নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তখন বিহারিরাই বেশি করতো। ৮০ এর দশকে বাঙালিরা কাজ শিখে বডি নির্মাণ কাজ শুরু করে।  তবে এখন কাজ শেখার আগ্রহী লোকের সংকট রয়েছে। কারণ কেউ কম বয়সে কাজ শিখতে এলে তাকে ৪০০০ হাজার টাকা দিলে সে খুশি হয় না। কারণ সে অন্য পেশায় গেলে বেশি টাকা পায়। কিন্তু গ্যারেজ মালিকের পক্ষে তাকে এরচেয়ে বেশি টাকা দেয়াও সম্ভব না। গত দুই বছর ধরে করোনার কারণে এমনিতেই কেউ গাড়ি বানায়না। তাছাড়া বডি নির্মাণের উপকরণের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এসব কারণে গ্যারেজ মালিকরা আর্থিক সংকটে রয়েছেন। বর্তমানে ৪২ সিটের বড় বাসগুলোর বডি নির্মাণে খরচ পড়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। চট্টগ্রামে অসংখ্য গ্যারেজ থাকলেও সব গ্যারেজ বডি বানাতে পারে না। সিটি গেইট, বহদ্দারহাট এক কিলোমিটার এবং বড়দিঘির পাড় এলাকা মিলে প্রায় অর্ধশত গ্যারেজ আছে যার বডি নির্মাণ করতে পারে। একেকটি গ্যারেজ বছরে ৩ থেকে ৪টি গাড়ি নির্মাণ করার সুযোগ পায়। তবে ঢাকায় বডি নির্মাণ করার গ্যারেজের সংখ্যা অনেক বেশি। দুই শতাধিক গ্যারেজ সেখানে রয়েছে। সেখানে বড় এসি বাসের বডিও নির্মাণ করা হয়।

লেখক: নিজস্ব প্রতিবেদক

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট