চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

অটোমোবাইলের ১৩৬ বছর

নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ২:১৬ অপরাহ্ণ

আধুনিক প্রযুক্তির অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন হলো অটোমোবাইল, যা মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছে। প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটেছে গাড়িরও। ১৮৮৬ সালের ২৯ জানুয়ারি কার্ল বেঞ্জ প্রথম গাড়ি নির্মাণ করেন। এর পর থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিনটি ‘বিশ্ব অটোমোবাইল দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই দিনটি বাংলাদেশে উদযাপিত হয়নি কখনো।

যদিও গাড়ির উদ্ভাবন ১৮৮৬ সালে। তবে গাড়ি উদ্ভাবনের চেষ্টা বা আকাঙ্খা ছিলো আরো আগে থেকে। ১৬৭২ সালে ফার্দিনান্দ ভারবিয়েস্ট একটি বাষ্পচালিত বাহন তৈরি করেন তৎকালীন চীনা সম্রাটের জন্য। এরপর প্রায় একশ’ বছর পরে ১৭৬৮ সালে, জোসেফ কাগনোট গণ পরিবহনের জন্য বাষ্পচালিত বাহন তৈরি করেন। ১৮৮৬ সালে কার্ল বেঞ্জ তেল চালিত গাড়ি উদ্ভাবন করেন যা সারা বিশ্বে পৃথিবীর প্রথম গাড়ি হিসেবে গণ্য করা হয়। ওই গাড়িটি “হর্সলেস ক্যারেজ” বা ঘোড়াবিহীন গাড়ি নামে পরিচিত ছিলো। কার্ল বেঞ্জ বেশ কিছু অটোমোবাইল এর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন এবং এগুলোর জন্য তিনি ১৮৮৬ তে জার্মানিতে পেটেন্ট লাভ করেন।

১৮৮৬ সালের ২৯ জানুয়ারিতে কার্ল বেঞ্জের উদ্ভাবিত গাড়িটি প্রথম রাস্তায় নামে এবং বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেয়। এই মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপন করা হয় “ওয়ার্ল্ড অটোমোবাইল ডে” হিসেবে। কার্ল বেঞ্জের স্ত্রী বার্থা বেঞ্জ বিশ্বের প্রথম গাড়ি চালান এবং তাকে বিশ্বের প্রথম চালক বলা হয়। বার্থা বেঞ্জ গাড়িটি অনেক দূর চালান এবং এটি বিশ্বের নজরে আসে এবং কার্ল বেঞ্জের প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত মার্সিডিস বেঞ্জের প্রথম গাড়ি বিক্রি শুরু হয়।

এবার ইঞ্জিনের কথায় আসা যাক। প্রায় সব গাড়িতে চার স্ট্রোক বিশিষ্ট পেট্রোল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। সেটি উদ্ভাবন করেন নিকোলাস অটো। একই ধরনের প্রযুক্তিতে ডিজেল ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন রুডোলফ ডিজেল। আজকাল জ্বালানি বা পেট্রোলচালিত ইঞ্জিনের বিকল্প হিসেবে অনেক সময়েই হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল এর নাম শোনা যায়। এটি ১৮৩৮ সালে ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডরিক উদ্ভাবন করেন।

কার্ল বেঞ্জ অটোমোবাইল উদ্ভাবন করলেও অটোমোবাইলকে জনপ্রিয় করার জন্য হেনরি ফোর্ডের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯০৩ সালে হেনরি ফোর্ড পৃথিবী বিখ্যাত “ফোর্ড মোটর কোম্পানি” প্রতিষ্ঠা করেন। হেনরি ফোর্ড মধ্যবিত্ত মার্কিন নাগরিকদের জন্য গাড়ি নির্মাণ শুরু করেন। তার গাড়ি নির্মাণের মধ্য দিয়ে গাড়ি একটি ব্যয়বহুল বস্তু থেকে মানুষের নাগালে আসতে থাকে। ফোর্ড কোম্পানির ফোর্ড মডেল গাড়িটি অটোমোবাইল এবং অটোমোবাইল শিল্পের মধ্যে বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়।

১৯০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে জেনারেল মোটর্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় যা বর্তমানে ৩৭ টি দেশে ১৩টি ব্রান্ডের নামে গাড়ি তৈরি করছে। বিখ্যাত বিএমডাব্লিউ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৬ সালে জার্মানিতে।

এডলফ হিটলার এর নাম শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে জড়িত নয়। পৃথিবী বিখ্যাত ভক্সওয়াগন বিটল গাড়ির প্রশংসা সবাই করে। অনেকেই গাড়িটি ব্যবহার করে। এই গাড়ির পেছনে হিটলারের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ১৯৩৪ সালের এপ্রিলে এডলফ হিটলার পোর্শে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ফার্ডিন্যান্ড পোর্শে’কে “পিপলস কার” বা জনগণের গাড়ি নামে একটি গাড়ি নির্মাণ করতে বলেন। এরপর ১৯৩৪ সালের মে মাসে হিটলার বার্লিনে একটি সভায় ফার্ডিন্যান্ড পোর্শেকে গাড়ি নির্মাণের জন্য আরো কিছু তথ্য প্রদান করেন যার মধ্যে একটি ছিলো গাড়িটি যেন দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৩ জন শিশু বহন করতে পারে।

হিটলার ঘোষণা করেন, এই ‘পিপলস কার’ নাজি জার্মানির নাগরিকদের জন্য তৈরি হবে এবং বিক্রি হবে একটি ছোট মোটরসাইকেলের দামে। উল্লেখ্য এই ‘পিপলস কার’ ই আজকের ভক্সওয়াগন বিটল। গাড়িটি ১৯৩৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তৈরি এবং বাজারজাত হয়। এই দীর্ঘ সময়ে এই গাড়ি প্রায় ২২ লক্ষটি নির্মিত হয়েছে।

এরকম আরেকটি ছোট গাড়ি হলো সিট্রোয়েন ২ সিভি। এটি ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তৈরি হয়। ত্রিশ এর দশকের ফ্রান্সের কৃষকরা যারা ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করতেন, তাদেরকে গাড়ি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সিট্রোয়েন ২ সিভি এর প্রকল্পটি সিট্রোয়েন কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট পিয়েরে বোল্যাংগার গ্রহণ করেন।

১৯৩৭ সালে জাপানের কিচিরো টয়োডা বিখ্যাত টয়োটা মোটর কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। তাদের বিখ্যাত টয়োটা করোলা গাড়িটি বিশ্বের অন্যতম বহুল বিক্রিত গাড়ি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে অটোমোবাইল এর ডিজাইনে একটি আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। গাড়ির ডিজাইন এবং নির্মাণ যুদ্ধের পরে ১৯৪৯ সালে যুদ্ধের ছায়া এবং সামরিক আগ্রাসন থেকে উত্থিত হয়। একই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটর্স কোম্পানি প্রথম ভি-৮ ইঞ্জিন এবং নতুন ডিজাইনে গাড়ি নির্মাণ শুরু করে।

১৯৪৮ সালে এনজো ফেরারি প্রতিষ্ঠা করেন ফেরারি। যার উদ্দেশ্য ছিলো দ্রুতগতির স্পোর্টস কার তৈরি করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গাড়ি নির্মাণ শিল্পের অন্যতম অগ্রদূত বলা হলেও ১৯৫৩ সালের আগে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কোন স্পোর্টস কার তৈরি হয়নি। ১৯৫৩ সালে শেভ্রলেট কোম্পানি তাদের স্পোর্টস কার শেভ্রলেট করভেট্ট বাজারে ছাড়ে। এটি আমেরিকার প্রথম স্পোর্টস কার।

বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় তিন গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ফোর্ড, ক্রাইসলার এবং জেনারেল মোটরস আংশিকভাবে বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ শিল্পের কর্তৃত্ব হারায় এবং জাপান সেই স্থানের অংশীদার হয় এবং জাপানি গাড়ি এশিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।

বিংশ শতাব্দীর একদম শুরুর দিকে বিদ্যুতচালিত গাড়ি উদ্ভাবিত হলেও একবিংশ শতাব্দীর আগে বাজার তেমন দখল করতে পারেনি। ১৯৯৭ সালে হাইব্রিড গাড়ির উদ্ভাবন হয় এবং টয়োটা তাদের হাইব্রিড গাড়ি প্রিয়াস বাজারে ছাড়ে। ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয় টেসলা মটরস। টেসলা মোটরস এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইলান মাস্ক সম্পূর্ণ বিদ্যুতচালিত গাড়ি নির্মাণ এবং তা জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেন। সেই উদ্যেগেই ২০০৭ সালে টেসলা মডেল এস বাজারে আসে। শুধু আমেরিকাতেই নয়, এই গাড়িটি গোটা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এভাবে প্রতিনিয়তই দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে অটোমোবাইল এর প্রযুক্তি নির্ভর উদ্ভাবন।

লেখক: নিজস্ব প্রতিবেদক

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট