চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

স্বপ্নের পথ ধরে হাঁটছে পিএইচপি

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ১:৫৭ অপরাহ্ণ

নাজিম মুহাম্মদ

 

‘আমাদের রাস্তায় আমাদের গাড়ি থাকবে সবার বাড়ি বাড়ি’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি খাতে দেশীয় অটোমোবাইলস প্রতিষ্ঠান পিএইচপি। মালেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডা. মাহাথির বিন মোহাম্মদের হাত ধরে ছয় বছর আগে যাত্রা শুরু করে পিএইচপি অটোমোবাইলস লি.। প্রতিষ্ঠানটি মালেশিয়ার প্রোটন ব্র্যান্ডের প্রাইভেট কার দেশেই সংযোজন করছে। পিএইচপি বাংলাদেশের বাজারে সর্বপ্রথম টকিং কার নিয়ে এসেছে। তাঁরা স্বপ্ন দেখেন ভবিষ্যতে ইলেক্ট্রিক গাড়ি বাজারজাত করবে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হালিশহরে অবস্থিত প্রোটনের কারখানায় তৈরি পাঁচ মডেলের প্রাইভেট কার চলছে  দেশের সড়কে। তা হলো- প্রোটন সাগা, প্রোটন সাগার এমসি, প্রোটন সাগা পারসোনা, প্রোটন সাগা প্রেভি ও প্রোটন এক্স-৭০ এসইউবি ( স্পোর্টস ইউটিলিটি ভ্যাহিকেল) টকিং কার। প্রতিটি গাড়ির পাঁচ বছরের ওয়ারেন্টি ও ফ্রি সার্ভিস সেবা দেয় পিএইচপি। ওয়ারেন্টির সময় সীমার মধ্যে কোন গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হলে তা মেরামত না হওয়া পর্যন্ত আরেকটি গাড়ি বিনামূল্যে গ্রাহককে ব্যবহার করতে দিচ্ছে পিএইচপি।

টকিং কার : প্রোটনের বিভিন্ন মডেলের গাড়ি দেশের বাজারে এনে সাফল্য পেয়ে আসছে পিএইচপি ফ্যামিলি। গাড়িতে বসে মুখে নির্দেশনা দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে  সে সব কাজ হয়ে যাবে। মুখে কোন বিষয় সাহায্য চাইলে জবাব দেবে গাড়িটি। বৃষ্টি আসলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়িটির উইপার্স কাজ করবে। এছাড়াও শ্রবণ প্রতিবন্ধী যে কেউ এ গাড়িটি চালাতে পারবেন। গাড়ি কোন লেনে চলছে, পথের নানা অসঙ্গতি শব্দের মাধ্যমে জানানো হবে চালককে।

এ গাড়িটিতে রয়েছে দেড় লিটারের টার্বো ইঞ্জিন, ম্যানয়েল মোডসহ সেভেন-স্পিড ডুয়েল ক্লাচ ট্রান্সমিশন, প্যানারমিক সানপ্রুপ, ৩৬০ক্যামেরা এন্ড সেন্সর, অটো ডুয়েল জোন এয়ার কন্ডিশনিং, ছয়টি এয়ারব্যাগ, টায়ার প্রেসার মনিটরিং সিস্টেম ও এয়ার পিউরিফায়ার সিস্টেম। এছাড়া দুর্ঘটনা সতর্কতা ও লেন ছাড়ার সতর্কতাও দেবে প্রোটন ব্র্যান্ডের  এক্স-৭০ মডেলের ব্র্যান্ড নিউ ২০২০ মডেলের এ গাড়ি। ভয়েসে কমান্ড দিয়ে গাড়িটি পরিচালনা করা হয় বলে একে বলা হয় টকিং কার এক্স-৭০ গাড়িতে ডুয়েল এসি ছাড়া কভিডের কথা বিবেচনা করে এন-৯৫ প্রটেক্টেট এয়ারক্লিনার লাগানো। এ গাড়িতে এয়ারকন্ডিশনের ঠিক উপরে একটি এন-৯৫ এয়ারক্লিনার দেয়া রয়েছে যেটি মালেশিয়া সরকার কর্তৃক অনুমোদিত পিএইচপি অটোমোবাইল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভেজ আখতার চৌধুরী জানান, ‘আমাদের রাস্তায় আমাদের গাড়ি, থাকবে সবার বাড়ি বাড়ি’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে পিএইচপি অটোমোবাইল। পিএইচপি কারখানায় আমাদের দেশের সন্তানরা গাড়ি সংযোজন থেকে রং করা সবই করছে। একটি প্রাইভেটকারে আট হাজার ৩৩২টি খুচরা যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়। আমরা চট্টগ্রামের কারখানাতেই ২৬টি খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করছি। আরো ১৫০ যন্ত্রাংশ আমরা তৈরি করতে সক্ষম। দিন দিন গ্রাহক বাড়ছে প্রোটনের। অনেকে আছেন রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবহার করলে পাশাপাশি নতুন গাড়ি ব্যবহার করছে। এক প্রশ্নের জবাবে পারভেজ আকতার বলেন, ভবিষ্যতে আমরা ইলেক্ট্রিক গাড়ি তৈরির স্বপ্ন দেখি। যদিওবা বাংলাদেশে এখনো ইলেক্ট্রিক যানবাহনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। লন্ডন কিংবা আমেরিকার সড়কেও ইলেক্ট্রিক যানবাহনের চলাচল পুরোপুরি শুরু হয়নি।

যেভাবে যাত্রা শুরু : পিএইচপি অটোমোবাইলে যাত্রা শুরুর কথা বলতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবাস্থাপনা পরিচালক পারভেজ আকতার চৌধুরী বলেন, আমাদের অটোমোবাইলসে যাত্রা শুরু হয় মালেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদের হাত ধরে। আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে ইউআইটিএস বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কনভোকেশন ছিল। সেখানে মালেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহাথির বিন মোহাম্মদকে দাওয়াত করি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশে কথা বলার জন্য। সেখানে এসে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে অসাধারণ একটি বক্তব্য রাখেন। তিনি একরাত বাংলাদেশে ছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাস ভবনের তাকে নৈশভোজের দাওয়াত দেন। তিনি সোনারগাঁও হোটেলে ছিলেন। সেখানে আমার বাবাসহ (পিএইচপির চেয়ারম্যান সুফী মিজানুর রহমান) সবাই ছিলাম। মাহাথির মোহাম্মদ বাবা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেন। তিনি মালয়েশিয়া ফেরার পর বাবাসহ আমাদের সবাইকে দাওয়াত করেন। তিনি তখন প্রোটনের চেয়ারম্যান ছিলেন। বাবা মালেশিয়া গিয়েছিলেন। তখন মাহাথির বাবাকে প্রোটনের কারখানা পরিদর্শন করতে বলেন। তখন তিনি বললেন, মিজান তুমি তোমার দেশে অটোমোবাইলসের একটি কারখানা করো। বাবা তখন বললেন, স্টিল, গ্লাস এসব বিষয়ে আমার অভিজ্ঞাতা রয়েছে। কিন্তু অটোমোবাইল সেক্টরে আমার অভিজ্ঞতা নেই।

তখন মাহাথির বললেন আমি তোমাকে সাহায্য করবো। তুমি এগিয়ে যাওয়া। তখন থেকে আসলে আমাদের যাত্রা শুরু। পারভেজ আকতার বলেন, আমরা চিন্তা করেছিলাম কীভাবে বাংলাদেশে অটোমোবাইলসে কারখানা করা যায়, কারণ আপনি যদি গার্মেন্টস কারখানা করতে যান অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক পাবেন। অটোমোবাইল  সেক্টরটি আসলে স্রোতের বিপরীত। আপনি যদি পাঁচ বছরের পুরনো গাড়ি এনে বিক্রি করেন আপনাকে সবাই বাহবা দেবে। সব ধরনের সাপোর্ট পাবেন। আপনি যখন ভিন্ন একটি চ্যালেঞ্জ নিবেন তখন কিন্তু আপনার বাধাগুলো আসে। প্রথম যে বাধা আমরা পেলাম তা হচ্ছে  ফ্যাক্টরি করার জন্য কোন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোক আমরা খুঁজে পাইনি। কারণ ফ্যাক্টরি তো হয়নি বাংলাদেশে পাবেন কোথা থেকে। তখন আমরা মালয়েশিয়া, জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েকটি গাড়ি কারখানা পরিদর্শন করি। বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে আমরা নিজেরা কাজের পরিকল্পনা করি। চ্যালেঞ্জ ছিল একটাই, আমাদের আসলে দক্ষ লোক পাওয়া যাচ্ছিলো না।  এ ক্ষেত্রে দক্ষ লোক পাওয়া চ্যালেঞ্জ ছিল। পরে বাংলাদেশ থেকে ইঞ্জিনিয়ারদের মালয়েশিয়া পাঠানো হয়। সেখান থেকে ট্রেনিং দিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। পরবর্তীতে যখন আমরা  সফলভাবে কারখানা চালু করতে পেরেছি তখন মালেশিয়ার প্রকৌশলীরা বাংলাদেশে আসতো। কয়েকদিন থাকতেন। গাড়ি সংযোজন কীভাবে করতে হয়, রং কীভাবে করতে সবকিছুর আলাদা আলাদা প্রকৌশলী আসতো মালয়েশিয়া থেকে। তারাই আমাদের দেশীয় প্রকৌশলীদের কাজের মান বাড়ানোর কাজ করে। প্রথমে আমরা মালয়েশিয়া থেকে পার্টস এসে সংযোজন করে গাড়ি তৈরি করেছি। পরবর্তীতে আমরা নিজেরা রং তৈরি করেছি।

যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামের কারখানায় : বর্তমানে আমরা গাড়ির ২৬ টি পার্টস নিজের তৈরি করছি।  যতগুলো প্রোটন সাগা আপনার দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখেন সবকটি আমাদের দেশের ছেলেরা রং করেছে। একটি গাড়ি তৈরি করতে আট হাজার ৩’শ ৩২টি যন্ত্রাংশ লাগে। কোন জায়গা থেকে তো শুরু করতে হবে। প্রথমদিনে তো আর ১০০, ২০০ যন্ত্রাংশ তৈরি করা সম্ভব নয়। তবে আমরা মনে করি এটা অনেকদূর যাবে ইনশআল্লাহ। আমাদের দেশের মানুষকে পুরনো গাড়ি আর ব্যবহার করতে হবে না। রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করতে হবে না বিদেশ থেকে। আমরা  সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সামনের দিকে হাঁটছি।

খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করা প্রসঙ্গে আখতার পারভেজ বলেন, আমরা কিন্তু ১৫০টির বেশি যন্ত্রাংশ তৈরি করতে সক্ষম। যন্ত্রাংশ তৈরি করতে পারলেও তা চাইলেই ব্যবহার করা যাবে না। কোন একটি যন্ত্রাংশ তৈরি করলে  মালয়েশিয়া থেকে প্রোটনের প্রকৌশলীরা আসেন। তারা দেখেন কীভাবে এটি আমরা তৈরি করছি। তখন যদি দেখেন আমাদের যন্ত্রাংশ তৈরির পদ্ধতি ঠিক আছে তখন গাড়িতে লাগানোর অনুমতি দেয়া হয়। তবে সে গাড়ি চাইলের বাজারে বিক্রি করা যাবে না। সেই গাড়ি কারখানায় প্রায় ১০০০ কিলোমিটার চালানোর পর যদি দেখা যায় মালেশিয়ার তৈরি আর এখানকার তৈরি সমমানের। সবকিছু একই সমমানের হলে তখন যন্ত্রাংশটি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। কভিড পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেলে আমরা আশা করছি আরো ১৫০ যন্ত্রাংশ গাড়িতে ব্যবহার করার অনুমতি পাবো। কারণ করোনার কারণে মালয়েশিয়ার প্রকৌশলীদের দেশে আনতে পারছি না।

যদি গাড়ির সব যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে তৈরি করা যায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে। কারণ এক একেকটি যন্ত্রাংশ নিয়ে একেকটি কারখানা গড়ে উঠবে। খুচরা যন্ত্রাংশ গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পিএইচপির অটেমোবাইলসের সুনির্দিষ্ট অ্যাপস রয়েছে। যেখানে ছবিসহ প্রতিটি যন্ত্রাংশের মূল্য তালিকা দেয়া রয়েছে। একজন গ্রাহক অ্যাপস ব্যবহার করেই গাড়ির যে কোন খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয় করতে পারবেন অনায়াসে। ক্যাশ অন ডেলিভারি আর বিকাশ সুবিধাও রয়েছে। একটি যন্ত্রাংশ অর্ডার দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম এবং ঢাকা মেট্রো এলাকার ডেলিভারি  দিয়ে থাকি। যদি ডেলিভারি দেয়া সম্ভন না হয় তাহলে বিনামূল্যে যন্ত্রাংশ দিয়ে দেবো।

বাজারে পাঁচ মডেলের গাড়ি : পারভেজ আকতার বলেন, পিএইচপি অটোমোবাইলে বর্তমানে ২৭’শ লোক কাজ করে। যখন আমরা দেড়শো খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির অনুমতি পাবো তখন মানুষের কর্মসংস্থান আরো বাড়বে। আরো প্রকৌশলী বাড়াতে হবে। একটি গাড়ি তৈরি করা খুবই সহজ নয়। অনেক কিছুর মিশ্রণে একটি গাড়ি তৈরি হয়।

পিএইচপি বাংলাদেশে এখন পাঁচ মডেলের প্রাইভেট গাড়ি বিক্রি করছে।  এরমধ্যে সেডান কার প্রোটন সাগা, প্রোটন সাগা এমসি, প্রোটন পারসোনা এমসি, প্রোটন প্রেভি ও প্রোটন এক্স-৭০ টকিং কার। এক্স টকিং কার বাংলাদেশে প্রথম টকিং কার। স্পোর্টস ইউটিলিটি ভ্যাহিকেল (এসইউভি)।

সমস্যা :

ফ্যাক্টরি করার সময় দক্ষ লোক পাওয়া কঠিন ছিল। এখন গাড়ির বিক্রি বেড়েছে। আর বিক্রির সাথে সাথে আমাকে গাড়ি আরো বেশি তৈরি করতে হচ্ছে। আর গাড়ি তৈরি বাড়াতে গেলে আমার এখন যে পরিমাণ জনবল রয়েছে তা  দিয়ে সম্ভব নয়। নতুন জনবল দরকার। সে জনবল আমাদের দেশে পাওয়া খুবই সহজ নয়। বাংলাদেশে যদি অটোমোবাইল ইনস্টিটিউশন হয় যেখানে অটোমোবাইলস বিষয়ে পড়াশেনা হবে। তাহলে পিএইচপি নয়। আরো অনেকে ভবিষ্যতে অটোমোবাইলসে বিনিয়োগ করবে। তাদের জন্য সুবিধা হবে জনবল পেতে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে জাপানের প্রাইভেট কারের প্রতি আলাদা একটা দুর্বলতা কাজ করে। মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে নকিয়া ছাড়া অন্য কোন ফোন সেটের কথা কেউ চিন্তাও করতো না। যখন অ্যাপল আসলে তখন অনেকে হাসতো। নকিয়া থেকে কি অ্যাপল বেশি বিক্রি হবে। কিন্তু এখন দেখেন নকিয়া অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কারণ যুগের সাথে তারা তাল মিলাতে পারেনি। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন নির্দেশনাগুলো তাদের ভাষাতেই দেয়া থাকে। কিন্তু পিএইচপির প্রতিটি গাড়িতে সব নির্দেশনা ইংরেজিতেই দেয়া হয়েছে। যাতে মানুষ সহজেই বুঝতে পারে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট