চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আজও গড়ে তোলা যায়নি পূর্ণাঙ্গ গাড়ি নির্মাণ শিল্প

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ১:৪৬ অপরাহ্ণ

ইফতেখারুল ইসলাম

 

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ গাড়ি শিল্প নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। তার প্রধান কারণ হল সরকার দেশে গাড়ি শিল্প নির্মাণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনুকূল পলিসি গ্রহণ করতে পারেনি। অথচ আমাদের দেশে গাড়ির বিশাল বাজার রয়েছে। এই চাহিদা আমদানি করেই মেটানো হচ্ছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান পূর্বকোণ এর সাথে একান্ত আলাপকালে একথা বলেন।

মিজানুর রহমান বলেন, আমরা আমদানি করেই গাড়ির প্রয়োজন মেটাচ্ছি। মূলত রিকন্ডিশন গাড়িগুলো জাপান থেকে এনে ব্যবহার করছি। একইসময়ে ভারত জয়েনভেঞ্চারে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এসে তাদের শিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছে। একদিকে তাদের গাড়ির চাহিদা মেটাচ্ছে। অপরদিকে তাদের আমদানি ব্যয় কমে যাচ্ছে। সেই পলিসি আমাদেরও নেয়া উচিত। যেমন আমরা সিএনজি ট্যাক্সিগুলো ভারত থেকে আমদানি করছি। তা আমদানি না করে জয়েনভেঞ্চারে এখানে কারখানা করতে পারি। তাতে আমাদের আমদানি ব্যয়টা কমে যেত। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হত। অপরদিকে, আমাদের মার্কেটেই আমাদের গাড়িগুলো ব্যবহার করতে পারতাম। বাংলাদেশে গাড়ির মার্কেট ছোট নয়। ১৮ কোটি মানুষের এই বিশাল মার্কেটে প্রচুর গাড়ির চাহিদা রয়েছে।

এর থেকে উত্তরণের উপায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাতীয় পর্যায়ে পলিসি ডেভেলপ করতে হবে। যা গাড়ি শিল্পের বিকাশে সাহায্য করবে। কিছু কিছু শুরু হচ্ছে। পিএইচপি গ্রুপ শুরু করেছে। মালয়েশিয়ান প্রোটন গাড়ি এসেম্বলি শুরু করেছে। এটা অবশ্যই ভাল দিক। এসেম্বলি করলেও তো আমরা কিছু সেভ করছি। কিছু কিছু পার্টস যদি ধীরে ধীরে ফেব্রিকেশনে যেতে পারি তাহলে তো আরো ভাল। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীতে কোন একটা গ্রুপ জয়েনভেঞ্চারে গাড়ির কারখানা নির্মাণের চিন্তা-ভাবনা করছে। যেখানে তৈরি হবে বিদ্যুৎচালিত কার। দেরিতে হলেও এটা আসলে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে এই শিল্পের ছোঁয়া লেগেছে। দেশে গাড়ি নির্মাণ শিল্প এগিয়ে যাবে।

সিএনজিচালিত ফোর স্ট্রোক ট্যাক্সির কিছু পার্টস তৈরির ক্ষুদ্র কারখানা চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু তারা ভারত এবং চীন থেকে আমদানিকৃত পার্টসের সাথে  প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এখানে করণীয় কি। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সহজ কথায় বলতে গেলে, আমরা যদি আমাদের শিল্পকে প্রসারিত করতে চাই তাহলে অবশ্যই আমদানি বন্ধ করতে হবে। ক্ষুদ্র শিল্পগুলো সুরক্ষা পেলে একদিন তারাও বড় কোম্পানিতে পরিণত হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতে ধনী লোকের অভাব নেই। বিশ্বের যেকোন দামি ব্রান্ডের গাড়ি ব্যবহারের ক্ষমতা ভারতের অনেক ব্যক্তির রয়েছে। কিন্তু তারা তাদের দেশীয় উৎপাদিত ব্রান্ডের গাড়ি ব্যবহার করছে। সরকার দেশীয় গাড়ি ব্যবহার করতে বাধ্য করছে। আমদানি বন্ধ করে একইসাথে দেশীয় উৎপাদনকে সুরক্ষা দিয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে দিলে জনগণ সেই গাড়ি ব্যবহার করবে। নিজের প্রতি নিজের দরদ থাকতে হবে। কীভাবে নিজের শিল্পকে গড়ে তুলে বাঁচাব তার নীতি সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে।

প্রগতির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রগতি থেকে সরকার সব গাড়ি কিনে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইচ্ছে করলে অন্য যেকোন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান বা আমদানিকারকের কাছ থেকে গাড়ি কিনতে পারে। অথচ প্রগতিকে বাঁচাতে এবং এর বিকাশ ঘটাতে সরকারি সব ধরনের গাড়ি শুধু প্রগতি থেকে কেনা বাধ্যতামূলক করা যায়। একইসাথে প্রগতিকে শুধুমাত্র গাড়ি এসেম্বলির কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জয়েনভেঞ্চারের মাধ্যমে কীভাবে গাড়ি নির্মাণ করা যায় তার চিন্তা-ভাবনাও সরকারের করা উচিত।

কোন শিল্পগ্রুপ গাড়ি নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগ করলে দক্ষ জনবল পাবে? গাড়ি নির্মাণের দক্ষ জনবল বাংলাদেশে আছে ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিমেন্ট, রড, গ্লাস, সিরামিকসহ অনেক ভারী শিল্প কারখানা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতগুলো স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ চট্টগ্রামে আছে। এসব তো দেশের লোকজনই চালাচ্ছে। শুরুর দিকে হয়তো ভারত কিংবা অন্যকোন দেশের দক্ষ লোকজন এসে কারখানা চালু করেছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পর বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের হাতেই তা হস্তান্তর করা হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশি দক্ষ জনবলই এসব কারখানা চালাচ্ছে। গাড়ি নির্মাণ শিল্পের ক্ষেত্রেও একইভাবে কাজ করা যায়। তাছাড়া বাংলাদেশের চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) দেশের বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব শিক্ষার্থী পাস করে বের হচ্ছে তারা বিদেশের অনেক বড় বড় গাড়ি নির্মাণ কারখানায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। যোগ্যতা না থাকলে কখনো বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশি প্রকৌশলীদেরকে তারা কোম্পানিতে নিয়োগ দিত না।

জয়েনভেঞ্চারে কীভাবে কাজ হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশীয় কোন কোম্পানি যখনই জয়েনভেঞ্চারে কোন বিদেশি কোম্পানির সাথে কাজ করবে, তখন প্রযুক্তি হস্তান্তর হবে। তাদের সাথে একটি চুক্তি থাকে। চুক্তিতে উল্লেখ থাকে দেশীয় প্রকৌশলীদের কত বছর প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলবে এবং কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তর করবে। একটি গাড়ির মূল অংশ ইঞ্জিন। জয়েনভেঞ্চারে যখন কাজ শুরু করবে আমি বলব শুরুতেই ইঞ্জিন বানানোর দরকার নেই। প্রথমে অন্যান্য অংশগুলো তৈরি করে ধীরে ধীরে ইঞ্জিন নির্মাণের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। চুক্তিতে এসব উল্লেখ থাকে কত বছরের মধ্যে সব ধরনের প্রযুক্তি দেশীয় কোম্পানির কাছে বিদেশি কোম্পানি হস্তান্তর করবে। একসময় দেখা যাবে দেশে ইঞ্জিনসহ সম্পূর্ণ গাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। এভাবেই এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে। যেখানে বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা বড় বড় স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ চালাচ্ছে। সেখানে গাড়ি শিল্প তার তুলনায় কিছুই না। আমাদের জনবলের সক্ষমতা আছে।

জনবলের দক্ষতার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এখানে যে সিএনজি ট্যাক্সিগুলো আমদানি করে চালানো হচ্ছে। এটি অতিসাধারণ একটি গাড়ি। ছোট একটি ইঞ্জিন নিয়ে এই গাড়ি চালানো হচ্ছে। আমাদের দেশের দক্ষ লোকজন যেখানে বিলাসবহুল এয়ারকন্ডিশন বাসের বডি তৈরি করছে, তার তুলনায় সিএনজি ট্যাক্সির বডি কিছুই না। অথচ আমাদের এখানে সিএনজি ট্যাক্সি নিয়ে নানা সময়ে কত কা-কারখানা ঘটে গেছে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে আমদানিকারকদের দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু ? যখনই পিএইচপি কিংবা অন্যকোন শিল্পগ্রুপ যখন গাড়ি নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করছে সেসময় রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানিকারকরা এর বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে সরকারকে সিদ্ধান্ত দিতে হবে যে, কোনটাতে দেশ উপকৃত হবে। সেভাবেই সরকারকে ঠিক করতে হবে। আমাদের যে শ্রম বাজার সহজেই বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পারি। টয়োটা দেশীয় গাড়ি উৎপাদনের বড় বাধা। কারণ টয়োটার একটা ব্রান্ড ভ্যালু আছে। আমরা যদি পুরনো গাড়ি আমদানি বন্ধ করতে পারি তাহলে দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটবে।

লেখক: নিজস্ব প্রতিবেদক

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট